ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

কপ-১৭: জলবায়ু পরিবর্তনে গৃহহীন হচ্ছে লাখো মানুষ

প্রতীক বর্ধন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১১
কপ-১৭: জলবায়ু পরিবর্তনে গৃহহীন হচ্ছে লাখো মানুষ

জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাব বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে দেখা দিয়েছে। তাপমাত্রার চরম ভাবাপন্নতা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ঘন ঘন বন্যা, সাইক্লোন, খরা প্রভৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে প্রকৃতি তার নিজের ছন্দে নেই।

ইতোমধ্যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশেকে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে আক্রান্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় হিমালয়ের বরফ দ্রুত গলছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম দু’টি বৃহৎ নদী: পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র  প্রবাহিত হওয়ায় এর ফলে আমাদের উপকূলের অনেক এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। আমাদের উপকুলাঞ্চলে সাড়ে তিন কোটি মানুষ বসবাস করায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা রয়েছে। আর সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অভাবে পরিস্থিতি হবে আরও নাজুক।
     
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে গত ৩৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র ঠান্ডায় ১৩০ জন মানুষ মারা যায় সেসময়। ফসল উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে কারণে। আবার ২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২.০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পানি শূন্যতা ও আরও বিভিন্ন অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ সেসময় আইসিডিডিআরবি-তে ভর্তি হয়।

এদিকে রাতের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যার আভাস ইতোমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা নিশ্চিতভাবেই ব্যাহত হবে। সরকারকে তাই এখনই বিকল্প চিন্তা শুরু করতে হবে।  
    
সাথে রয়েছে ঘন ঘন বন্যা, সাইক্লোন, সামুদ্রিক জলোচ্ছাস প্রভৃতি। বাংলাদেশে বিগত ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে দু’বার বন্যা হয়েছে। এত ঘন ঘন বন্যা এদেশে আগে হয়নি। সমুদ্রেও ঘন ঘন নি¤œচাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বছরের অনেক সময়ই সমুদ্র ও নৌ বন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত ঝুলছে। পাশাপাশি, গত কয়েক বছরে সিডর, আইলা’র মতো ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উপকুলাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় সাতক্ষীরা, খুলনার অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে নোনা পানি ঢুকে পড়ে, যা এখনও সরেনি। ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও অনেক হতদরিদ্র মানুষ এখনও এক প্রকার খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করছেন। ঘর বাড়ি মেরামত করার মতো অবস্থা তাদের নেই, সরকারের তরফ থেকেও সেরকম কোন উদ্যোগ নেই। বরাদ্দ যা হয়েছিল তা যথারীতি লুটপাট হয়ে গেছে।         


উদ্বাস্তু কথন

২০০৯ সালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ১৭ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। ২০১০ সালে তা দাঁড়ায় ৪২ মিলিয়নে, ২০০৮ সালে যা ছিল ৩৬ মিলিয়ন। সংখ্যাটা আঁতকে ওঠার মতোই। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের বেঁচে থাকবার অধিকার রয়েছে! কিন্তু কথা হচ্ছে যারা ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন তাদের কী হবে, আর যারা হুমকির মুখে রয়েছেন তাদেরই বা কী হবে?

আশার কথা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে ঘর বাড়ী হারানো মানুষ শরণার্থী মর্যাদা পেতে যাচ্ছেন। গত ৫-৭ জুন, ২০১১ নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত ন্যানসন সম্মেলনে প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহ ও পেশা হারানো মানুষদের আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে একটি নীতিমালা ঘোষিত হয়েছে।

এই নীতিমালাকে আইনে পরিণত করার জন্য জাতিসংঘের কাছে তা উত্থাপন করা হবে। বর্তমানে জেনেভা শরণার্থী আইনে শুধুমাত্র যুদ্ধ ও দুর্যোগের কারণে গৃহহীন হয়ে যারা অন্যত্র বসবাস করে তাদের শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে শুধুমাত্র ২০১০ সালেই যে ৪.২ মিলিয়নের অধিক মানুষ গৃহহীন হয়েছে তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনরকম সহায়তা পাচ্ছেন না।

এই নীতিমালার আওতায় জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষেরা জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের আওতায় চলে আসবেন। ন্যানসন নীতিমালায় নয়টি শর্তের মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে গৃহহীন হওয়া মানুষদের মৌলিক মানবাধিকার, সম্মান, অধিকার, ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দিতে হবে। এর ফলে রাষ্ট্রকে প্রাথমিকভাবে গৃহহীন ও মানুষের দায়িত্ব নিতে হবে। যারা গৃহহীন হয়েছে ও ঝুঁকির মাঝে রয়েছে, তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদ সরবরাহ ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা দিতে হবে।

কিন্তু আশংকার কথা হচ্ছে গত কয়েক দশকে পৃথিবীতে যে হারে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও তাতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে আমাদের জন্য তা এক অশনিসংকেত। এর মধ্যে বন্যা ও ঝড়ের কারণে ২০০৯ ও ২০১০ সালে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ গৃহহীন হয়েছে। শুধুমাত্র এ দুটি কারণে ২০০৯ সালে ১৫ মিলিয়ন ও ২০১০ সালে ৩৮ মিলিয়ন মানুষ ঘারবাড়ি হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ২০০৯ সালে ভারতের বন্যা, শুধুমাত্র এ কারণেই ভারতে পাঁচ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। তবে এর চেয়েও ধ্বংসাত্মক ছিল ২০১০ সালে চীন ও পাকিস্তানের বন্যা, এর ফলে চীনে ১৫ মিলিয়ন ও পাকিস্তানে ১১ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে ৮০ বছর পর এ বন্যা হয়। ফলে বন্যার সাথে পরিচিত না হওয়ায় এখানকার মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর ২০০৮ সালে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয়ে গৃহহীন হয় ২০ মিলিয়ন মানুষ।

আইডিএমসির এক গবেষণাপত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের সিডর আইলা ও বন্যায় প্রায় ১ মিলিয়িন মানুষ গৃহহীন হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড় সিডর ও আইলার কারণে সাতক্ষীরা, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছেন। অনেকে আবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতেও যাচ্ছেন। এতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এশিয়া মহাদেশই অধিক আক্রান্ত হয়েছে। এখানেই সবচেয়ে বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে। চীন, ভারত ও ফিলিপাইনে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, একইসাথে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী বিপর্যয়ও হয়েছে এই মহাদেশে।

সরকার বলছে, স্বাধীনতার পর আমাদের জিডিপি ৩ গুণ বেড়েছে, খাদ্য উৎপাদনও সমপরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এতে দরিদ্র মানুষ অতি সামান্যই লাভবান হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ২.৯%, ২০০৬ সালে সে তা দাড়িয়েছে ১.৪%-এ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আমাদের জিডিপি’র তথাকথিত উর্ধ্বমুখী সূচক নিচে নেমে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই সরকার এই উর্ধ্বগতি বজায় রাখার জন্য সরকার জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় একটি নীতিমালা ঘোষণা করেছে। এই নীতিমালায় ছয়টি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা, কার্বন উদগিরণ কমানো,  সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন সংহতকরণ।

পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফাণ্ডের বিপুল পরিমাণ টাকাও আমাদের পাওয়ার কথা রয়েছে। বিশিষ্ট পরিবেশবীদ ড. আইনুন নিশাতের মতে আমাদের অর্থ নিয়ে কোন সমস্যা নেই। প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও আছে, আমাদের প্রয়োজন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা। এই টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করে সরকারের ঘোষিত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এই সংকট আমরা মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।

প্রশ্ন তবুও থেকে যায়, শুধুমাত্র ফাণ্ডের টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে?

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে সবাই মাথায় জল ঢালছেন। এ সংকট মোকাবিলায় কিছু কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে অনেক কচকচিও হচ্ছে । কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখছি জলো”চ্ছ্বাস, বন্যা, ঝড় এগুলো কেন এত ঘন ঘন হচ্ছে। কেন অসময়ে অধিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে, আবার কেন প্রয়োজনের সময় বৃষ্টি হচ্ছেনা? কেন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতির অস্বাভাবিকতার উৎস সন্ধান না করে এর বিরূপ প্রভাবকে মোকবিলা করা যাবেনা। তাই যেতে হবে মূলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে উন্নত দেশগুলোই প্রায় শতভাগ দায়ী। তারা তাদের তথাকথিত উন্নয়নের জন্যে  কার্বন নিঃসরণ কমাতে রাজী নয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভূমিকা এখানে নগন্য, তবে ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরাই। আমাদের ভূ প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণেই তা হচ্ছে। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত এসব মানুষের দায়ভার নেয়ার জন্য উন্নত দেশগুলোকে চাপ দেয়া। জাতিসংঘকেও এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করার জন্য চাপ দিতে হবে। কারণ দুনিয়াটা শক্তের ভক্ত নরমের যম। নিজেদের অবস্থান তাই শক্ত করতে হবে। এতে উন্নত দেশগুলো কার্বন উদ্গিরণ কমাতে বাধ্য হবে।

পুনশ্চঃ  চলমান ডারবান সম্মেলনে ইতামধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, কানাডা ও ভারত কিয়োটো প্রটোকল আর মেনে চলতে রাজী নয়। অর্থাৎ কার্বন নির্গমন কমার কোন লক্ষণ আপাতত নেই। অথচ অধিক কার্বন নির্গমনকেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধানতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদিকে এ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আবারও  জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বলা হয়েছে। তাই এখন আমাদের মতো দেশগুলোর উচিত এসব সম্মেলনে যোগ না দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নিয়ে জোট গঠন করে উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নির্গমন কমাতে বাধ্য করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা।       

তথ্যসূত্র:
১.   Displacement due to natural hazard induced disasters Global Estimates   
       for 2009 and 2010, a joint research report by iDMC & NRC

২.  National Policies for Disaster Management, by Government, People’s
      Republic of Bangladesh & UNDP.

বাংলাদেশ সময়: ২৩১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।