বাগেরহাট : অসুস্থ হয়ে পড়েছে বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাজী খানজাহান (রহ.) এর মাজার সংলগ্ন দিঘির পুরুষ কুমির মাদ্রাজ। কুমিরটি দিঘির উত্তর পাড়ে বিনার বাড়ি সংলগ্ন ঘাটে অবস্থান করছে।
শনিবার (১২ জুন) সকাল থেকে এই অবস্থা হলেও সোমবার (১৪ জুন) দুপুরে বিষয়টি সবাইকে জানায় বিনা বেগম নামে ওই নারী। কুমিরের অসুস্থতার খবর পেয়ে দিঘিতে ছুটে যান বাগেরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. লুৎফার রহমান।
বিনা বেগম বলেন, দিঘিতে থাকা দুটি কুমির প্রায়ই আমার ঘাটে আসে। আমি মানুষকে দেখাই এবং খেতেও দেই। শুক্রবার রাতে পুরুষ কুমির “মাদ্রাজ” আমার ঘাটে আসে। অন্যান্য সময় খাবার দিলে সঙ্গে সঙ্গেই খেয়ে ফেলত। কিন্তু শনিবার সকাল থেকে খাবার দিচ্ছি কিন্তু খাচ্ছে না। রোববারও আমাদের দেওয়া খাবার খায়নি। সোমবারও খাবার খায়নি মাদ্রাজ। একবারের জন্যও চোখ মেলছে না কুমিরটি। মনে হয়েছে ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাই আমি সবাইকে খবর দিয়েছি।
বিনা আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কুমিরটির গলার মধ্যে একটি টিউমারের মত রয়েছে। ওই কারণেও অসুস্থ হতে পারে। আবার দিঘিতে অনেকে জাল পাতে ওই জালেও ওর পা আ নখ পেঁচানো থাকতে পারে।
বাগেরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. লুৎফর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি মাজারে এসেছি। দিঘির দুটো কুমিরই আমি দেখেছি। পিলপিল নামের কুমিরটি সুস্থ থাকলেও মাদ্রাজ নামের কুমিরটি অসুস্থ। আমি মাজার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি মাদ্রাজকে চিকিৎসা দিতে হলে কুমিরটিকে উপরে উঠাতে হবে। তাহলে তাকে আটকিয়ে, কন্ট্রোল করে তার চিকিৎসা শুরু করা যাবে। তার রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে পারলে আশাকরি সে আবারও সুস্থ হয়ে যাবে।
এদিকে মাজার সংলগ্ন এলাকার একাধিক বাসিন্দা দাবি করেছেন কুমির কেন্দ্রিক কিছু মানুষ এক ধরনের ব্যবসা করে আসছে। নিজের বাড়ির ঘাটে কুমির রাখার জন্য তারা নানা রকম ক্ষতিকর পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।
ফকির দারা নামের এক ব্যক্তি বলেন, ৬শ বছরের ঐতিহ্য এই কুমির ফকিররা ডাকলেই মানুষের কাছে আসত। কিন্তু কালা পাহাড়, ধলা পাহাড় মারা যাওয়ার পরে মাজারের দুই একজন ব্যক্তি তাদের ঘাটে কুমির রেখে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ব্যবসা শুরু করেছে। কুমিরকে নিজের ঘাটে রাখার জন্য মাংসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধও খাইয়ে থাকেন তারা। আবার নিজেদের ঘাটে আসলে বাইরে থেকে জাল বা নেটের বেরিকেডও সৃষ্টি করেন। যার ফলে কুমিরের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়। এসব কারণে কুমির অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
খানজাহান (রহ.) এর মাজারের প্রধান খাদেম ফকির শের আলী বলেন, পূর্ব পুরুষ থেকেই আমরা মাজারের কুমিরের দেখভাল করে আসছি। এই কুমিরকে কেউ আটকে রেখে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেবে, জাল দিয়ে কুমিরের চলাচল বাধাগ্রস্ত করবে এটা খুবই আপত্তিকর বিষয়। যদি কোনো ব্যক্তি এমন কাজ করে থাকে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব। জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এ ধরনের স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
সুলতানী শাসন আমলে খ্রিস্টীয় ১৪ শতকের প্রথম দিকে হযরত খান জাহান আলী (রহ.) বাগেরহাটে ‘খলিফতাবাদ’নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি ৩৬০ দিঘি খনন করেন। এর মধ্যে সব থেকে বড় ‘ঠাকুর দিঘি’। যে দিঘির পাড়ে তার সমাধি রয়েছে। এই দিঘিতে তিনি দুটো মিঠাপানির প্রজাতির কুমির এনেছিলেন। যাদের নামছিল ‘কালাপাহাড়’ ও ‘ধলাপাহাড়’। খানজাহান (রহ.) এর মৃত্যুর পর মাজারের খাদেম ও ভক্তরা ওই কুমির দুটিকে নিয়মিত খাবার দিতেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ওই কুমির যুগলের বংশ ধরেরা এখানে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময় মারা যাওয়ার কারণে কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড়ের বংশ ধরেরা আর বেঁচে নেই।
তবে ২০০৬ সালে মাজারের দিঘির মৃত ‘কালা পাহাড়’ কুমিরটির চামড়া ২০১৫ সালে মারা যাওয়া সর্বশেষ ঐতিহ্য ‘ধলা পাহাড়’ নামক কুমিরটির চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। বর্তমানে দিঘিতে থাকা মিঠা পানির কুমির দুটিকে মাদ্রাজ থেকে আনা হয়েছিল।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৫ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২১
আরএ