ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

পুইয়া, লইট্যা ট্যাংরা ও কুর্শা মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন

মো. আমিরুজ্জামান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২১
পুইয়া, লইট্যা ট্যাংরা ও কুর্শা মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন

নীলফামারী: নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এবার আরও তিনটি বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছেন। এ তিনিটি প্রজাতির মাছ হচ্ছে পুইয়া, লইট্যা ট্যাংরা ও কুর্শা মাছ।

 

এর আগে প্রতিষ্ঠানটি বালাচাটা, খলিশা, গুতম, ট্যাংরা, বৈরালী ও আঙ্গুস মাছের পোনা উৎপাদনের কলাকৌশল উদ্ভাবনে সফলতা পায়।

তিস্তা, রংপুরের চিকলী নদী, নীলফামারীর বরাতি ও বুড়িখোরা নদী থেকে মা মাছ সংগ্রহ করা হয়। সেই মা মাছ থেকে বিশেষ কায়দায় ডিম ফুটিয়ে রেণু পোনা উৎপাদন করা হয়। সেই পোনা উপকেন্দ্রের পুকুরে ছেড়ে বড় করা হয়। স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসানের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা যথাক্রমে ইশতিয়াক হায়দার, শওকত আহমেদ ও মালিহা হোসেন মৌ গবেষণা করে এসব মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন।  

আমাদের দেশে বটিয়া পুইয়া (Acanthocobitis botia) এলাকা ভেদে নাটোয়া, খলই মুচরী, বিলভারি ইত্যাদি নামে পরিচিত। সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার পাহাড়ি ছোট নদীতে এবং দিনাজপুর, রংপুর ও ময়মনসিংহ জেলার ছোট নদীতে এ মাছটি পাওয়া যায়। এ মাছ সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে গবেষণা করে রেণু পোনা তৈরি করা হয়। পুইয়া মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা ৫,০০০ থেকে ৮,০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাছটির প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট; তবে সর্বোচ্চ প্রজননকাল জুন মাসে।  

লইট্যা ট্যাংরা (Mystus bleekeri) হচ্ছে স্বাদুপানির একটি সুস্বাদু মাছ। অঞ্চলভেদে এ মাছটি নদীর ট্যাংরা, গুইল্লা ট্যাংরা বা লইট্যা ট্যাংরা নামে পরিচিত। দেশের উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ পূর্বের জেলাগুলোতে স্বাদুপানির নদী ও সংযুক্ত জলাশয়ে বিশেষ করে বর্ষা ও শীত মৌসুমে এদের পাওয়া যায়। উত্তরের জনপদ নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন নদী যেমন- তিস্তা, বুড়িখোরা, বারাতি, চিকলী ও ভুসি নদীতে এদের পাওয়া যায়। ২০২০ সালে প্রজনন মৌসুমে দেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে লইট্যা মাছের পোনা উৎপাদনে প্রাথমিক সফলতা অর্জিত হয়। প্রযুক্তিটি প্রমিতকরণের মাধ্যমে চলতি প্রজনন মৌসুমে তা চূড়ান্ত করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিপক্ক (২০-৩০ গ্রাম) ওজনের লইট্যা ট্যাংরার ডিম ধারণ ক্ষমতা ২৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুমে গবেষণা পুকুর থেকে সুস্থ সবল পরিপক্ক পুরুষ ও স্ত্রী মাছ বাছাই করে হ্যাচারিতে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের সাত-নয় ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ে। এদের ডিম আঠালো এবং প্রায় ২০ ঘণ্টা পর ডিম থেকে রেণু বের হয়ে আসে।  

কুর্শা (Labeo dero) মিঠাপানির একটি মাছ, যা অঞ্চলভেদে কুর্শা, খুর্শা বা কাতাল খুশি ইত্যাদি নামে পরিচিত। দেশের উত্তর জনপদে মাছটি কুর্শা, খুর্শা নামে পরিচিত। মিঠাপানির জলাশয় বিশেষ করে পাহাড়ি ঝর্ণা ও অগভীর স্বচ্চ নদী এদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। মাছটি সুস্বাদু ও মানবদেহের জন্য উপকারী অনুপুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ।

গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিপক্ক (২০০-২৫০ গ্রাম) কুর্শা মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাছটির প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট। তবে সর্বোচ্চ প্রজননকাল জুন মাস।  

স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান জানান, বিলুপ্ত প্রায় মাছের তালিকায় রয়েছে ৬৪ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে গবেষণায় ৩৪টি জাত ফিরে এসেছে। এ কেন্দ্র থেকে তিনটিসহ মোট নয়টি বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নে ২০০৬ সালে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে স্বাদুপানি উপকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আশা করি, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মাছগুলো আবার ফিরে আসবে।
এ উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শওকত আহমেদ বলেন, অনেক কষ্ট করে বিলুপ্ত প্রায় মাছগুলো নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। অনেক সময় রাত ৩টায় গিয়ে জেলেদের মাধ্যমে মাছগুলো সংগ্রহ করে আনা হয়েছে।  

তিনি বলেন, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদের দিক নির্দেশনা ও আমাদের আন্তরিক চেষ্টায় একের এক গবেষণায় বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করা সম্ভব হচ্ছে। ২০০৬ সালে সৈয়দপুরে স্বাদু পানি উপকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে গবেষণার কাজ অব্যাহত রয়েছে।
 
নির্বিচারে মাছ নিধন, বিশেষ করে নদীতে বানা ও কারেন্ট জাল দিয়ে বা জলাশয়ের পানি শুকিয়ে মাছ ধরা, কীটনাশক ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশি মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গবেষণায় মাছের সুদিন ফিরে আসছে। দেশের মৎস্য খাতে যথেষ্ট অবদান রাখবে এসব মাছ, যোগ করেন তিনি।  

স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের গবেষণা প্রসঙ্গে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য রাবেয়া আলীম বলেন, মাছের বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতিগুলো আবার ফিরে পাওয়া মূলত এক ঝাঁক বিজ্ঞানীর গবেষণার ফসল। তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি উপকেন্দ্রটি পূর্ণাঙ্গ স্টেশন করার দাবি জানাই।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২১
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।