ঢাকা : গত ৬ মে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে যে সতর্কতার বার্তা দিয়েছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা তা ছিল ভুয়া। তথ্যদাতারা রীতিমতো প্রতারিত করেছিল তাদের।
এ বিষয়ে ভারতের একটি হিন্দি পত্রিকায় প্রকাশিত শিরোনাম করা হয়েছে, “পাকিস্তাননে ভারত কো উল্লু বানায়া” অর্থাৎ পাকিস্তান ভারতকে ‘বুদ্ধু’ বানিয়েছে। পত্রিকার মতে, এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
ভারত সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৬ মে মুম্বাই হামলার পর অনেক তথ্যদাতা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, সাংবাদিক এমনকি রাজনীতিকদের পর্যন্ত অর্থের বিনিময়ে ‘নির্ভরযোগ্য তথ্য’ সরবরাহের প্রস্তাব দেওয়া শুরু করেন।
এমনি ‘তথ্যবন্যা`র ফাঁদে ফেলে গোয়েন্দা সংস্থাকে কয়েকজন এজেন্ট কিছু ছবি দেখিয়ে বলেন, এগুলো আইএসআই’র কিছু স্থাপনা বা সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। পাকিস্তানের ভেতরে এসব স্থাপনার সঠিক অবস্থান অবশ্য চিহ্নিত করে দেখানো হয়নি। এসব তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই না করেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের কথায় বিশ্বাস করে বসে। কারণ মুম্বাই হামলার পর সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে যে কোনো তথ্য পেতে তারা উদগ্রীব ছিল। আর সে কারণে ভুয়া তথ্যের ফাদেঁ পা দিয়ে বসে তারা।
অপরদিকে, পাকিস্তানে তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক যেমনটি মজবুত হওয়ার কথা বাস্তবে তা নয়।
এই পটভূমিতে কিছু ‘ছোটখাটো নির্ভুল তথ্য` দিয়ে এই চক্রটি প্রথমে গোয়েন্দা সংস্থার আস্থা অর্জন করে। পরে ওই তথাকথিত তথ্যদাতারা নিয়মিত তথ্য পাঠাতে থাকে। বিশেষ করে মুম্বাই হামলার পর তাদের তরফ থেকে পাঠানো তথ্যের রন্যা বয়ে যায়।
এরপর এইসব তথ্যদাতা ‘সন্ত্রাসীদের’ কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে বলে- এরা সমুদ্রপথে মুম্বাই প্রবেশ করেছিল। সেই সঙ্গে কথিত মুম্বাই হামলা পরিকল্পনার বিস্তারিত তথ্য সেখানে দেওয়া হয়।
খোদ ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র) এসব কথিত ‘গোয়েন্দা তথ্য’ অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নেয়। তারা যথারীতি জরুরি ভিত্তিতে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (গোয়েন্দা অধিদপ্তর) সঙ্গে আলোচনা করে বিয়টি নিয়ে। এ তথ্যের ভিত্তিতেই মাল্টিপল এজেন্সি সেন্টার ৬ মে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের পুলিশকে ২০১১ সালের মুম্বাই হামলার অনুরূপ হামলা হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তাদের সতর্ক করে দেয়।
জানা গেছে, এসব তথ্যের উৎস যাচাই না করেই গোয়েন্দা সংস্থা `র` ভুয়া তথ্যদাতাদের মোটা অঙ্কের টাকাও পরিশোধ করেছে।
পরে জানা যায়, সন্ত্রাসী বলে যে ৫ জনের ছবি দেওয়া হয়েছিল তাদের ৩ জন আসলে লাহোরের জনপ্রিয় ইলেক্ট্রনিক মার্কেট হাফিজ সেন্টারের মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী। এ গ্রুপের অপর দুজনের একজন একই মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী আর অপরজন কর্মচারী।
তারা যখন জানতে পারলেন তাদের ঘিরে মুম্বাইয়ে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কার খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তখন তারা লাহোর পুলিশের কাছে গিয়ে নিরাপত্তা চায়।
গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং ব্যবস্থাপনায় এমন বাজে অবস্থার পটভূমিতে এখন তথ্য এবং সূত্রের নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে এ সংক্রান্ত একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর ব্যাপারে তাৎক্ষণিক হালনাগাদ তথ্য পেতে অসমর্থ হওয়ার কারণে ভারত এভাবে বারবার প্রতারিত হচ্ছে।
ভারতীয় পত্রিকাগুলোর মতে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কোনো নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভারতের নেই। এ কারণে ভাড়াটে তথ্যদাতারাই তাদের ভরসা। আর এসব তথ্যদাতা সাধারণত হয়- চোরাকারবারি নয় তো ছিঁচকে অপরাধী। এরা আকর্ষণীয় আর চাঞ্চল্যকর সব তথ্য দিয়ে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দাবি করে বসে। বাস্তবে ওইসব তথ্যের উৎস যাচাই করা প্রায়ই অসাধ্য হয়ে পড়ে। তারপরেও পাকিস্তান বলে কথা! ভারতীয়রা চির শত্রু পাকিস্তান কেন্দ্রিক বা পাকিস্তান থেকে পাওয়া ওইসব তথ্যকে হটকেকের মতই লুফে নেয়।
এদিকে, ভারতের নিরাপত্তা বিভাগ এখন সন্দেহ করছে যে, ‘র’ কে দেওয়া ৬ মে কথিত সন্ত্রাসী হামলার ভুয়া তথ্যদাতাদের মধ্যে ডবল এজেন্টরাও থাকতে পারে।
এ ব্যাপার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এখনো পর্যন্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সীমান্তপথে চলাচলকারী ভাড়াটে চরদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য। আর এ কারণে তারা সীমান্ত পেরিয়ে এসে অপরাধ সংঘটনের সুযোগ পাচ্ছে। এমন নির্ভরশীলতা আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার অসহাত্বই প্রকাশ করে।
বাস্তব পরিস্থিতির কারণে, পাকিস্তানি ভাড়াটে চরদের কাছ থেকে দিল্লিমুখো এমন বিভ্রান্তিকর তথ্যের স্রোত সর্বদাই প্রবহমান ছিল, আছে এবং সামনেও থাকবে। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে ‘র’ সরকারকে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয় যে, পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নেওয়া একশ’ সন্ত্রাসী ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত এবং বন্দরে অবস্থান নিয়েছে। তারা ভারতে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। এদের টার্গেট মুম্বাই এবং দিল্লি। এদের মধ্যে জনা বিশেক সন্ত্রাসী পানির নিচ দিয়ে অভিযান পরিচালনার দক্ষতাসম্পন্ন (অর্থাৎ মেরিন কমান্ডো পর্যায়ের) বলে দাবি করে ‘র’।
এসব উত্তেজনাকর তথ্য প্রকাশের পর সেবারও ভারতের নিরাপত্তা বিভাগ কয়েক দফা বৈঠক করে। অনেক আলোচনা এবং বিশ্লেষণের পর তথ্যগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরপর ‘র’ তাদের সতর্কতা নিঃশব্দে প্রত্যাহার করে।
হিন্দি দৈনিক `নবভারত টাইমস`- এর মতে, একই ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশও দিয়ে চলেছে বাংলাদেশ সীমান্তে। গত বছর তারা দু’জন ‘সন্ত্রাসীর’ ছবি প্রকাশ করে দাবি করে এরা মুম্বাই হামলার পরিকল্পনা করছে। পরে জানা যায়, দুটো ছবিই ছিল ভুয়া।
একইভাবে আসাম পুলিশও সীমান্ত-চরদের সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে কয়েক বছর ধরে বারবার সন্ত্রাসী হামলার সতর্কতা জারি করে আসছিল। তবে বেশিরভাগ সতর্কতা পরবর্তিতে প্রত্যাহার করা হয়। এমনি ধারার ঘটনা পরম্পরায় আস্থা হারানোর পর এমন সতর্কতা জারি এখন বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১২
সম্পাদনা: জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan@banglanews24.com;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর