ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সিলোকোসিসে আরও এক মৃত্যু

‘চোখের জল শুকোবার আগেই মিশে যাবে ঘামে’

মোয়াজ্জেম হোসেন, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১৩, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১২
‘চোখের জল শুকোবার আগেই মিশে যাবে ঘামে’

লালমনিরহাট: আমদানি করা পাথর ক্রাশিংয়ের(গুঁড়া) কাজে নিয়োজিত এক শ্রমিক মরণব্যাধি সিলোকোসিস (Silicosis)-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

দীর্ঘ রোগভোগের পর মঙ্গলবার সকালে মৃত্যুবরণ করা ওই শ্রমিকের নাম আমিরুল হক (৪৮)।

তিনি পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের উফারমারা ঘুণ্টিগ্রামের মৃত আনা উদ্দিনের দ্বিতীয় পুত্র।
 
লালমমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকায় ভারত ও ভূটান থেকে আমদানি করা পাথর গুঁড়া করার কাজ করতেন তিনি।

আমিরুলের পরিবার ও বুড়িমারী স্থলবন্দরে কর্মরত শ্রমিকরা বাংলানিউজকে জানান, বিগত ২০০১ সালে বুড়িমারী স্থলবন্দরে ঢাকার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম সেন্টুর মালিকানাধীন ভিক্টোরি মোজাইক কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে আমিরুল হক শ্রমিকের কাজ নেন। একটানা তিনি ওই কারখানায় ৪ বছর বিভিন্ন ধরনের পাথর গুঁড়া করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

একপর্যায়ে তিনি মারাত্মক অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও আর সুস্থ্য হতে পারেননি। দিনদিন তার শরীর শুকিয়ে যাচ্ছিল।

একপর্যায়ে বিল্স নামের ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তার মত বেশ কয়েকজন শ্রমিককে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে মহাখালী জাতীয় বক্ষ্যব্যাধি ইন্সিটিটিউট ও হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করে। এ বছরের ১১জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমিরুল হকও ওই শ্রমিকদের সঙ্গে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ্য মনে করে তাদের মধ্য থেকে আমিরুলসহ ৪ শ্রমিক গত সোমবার বাড়ি ফেরেন। পরদিন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় আমিরুল হক নিজ বাড়িতে মারা যান।

চিকি‍ৎসকরা জানান, পাথর গুঁড়া বা সিলিকা ধূলি নিঃস্বাসে গ্রহণের ফলে সৃষ্ট ফুসফুসের এক কঠিন রোগ সিলিকোসিস। কয়লাখনির শ্রমিকদের মাঝে এই রোগ বিশেষভাবে দেখা যায়।

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাথর বা কয়লার গুঁড়া নাক দিয়ে ঢুকে ফুঁসফুফে ঢুকে। একপর্যায়ে ফুসফুফ পাথরের মত শক্ত হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।

উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকি‍ৎসকরা বাংলানিউজকে জানান,  সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত ৩ বছরে পাটগ্রাম উপজেলায় মরণব্যাধি সিলোকোসিসে ১৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

ভিক্টোরি মোজাইক কোম্পানির অপর শ্রমিক মোমিন আলী বাংলানিউজকে বলেন, “আমিও প্রতিবেশি আমিরুল হকের সাথে পাথর গুঁড়া করার কাজ করে সিলোকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছি। বাড়ির সবকিছু বিক্রি করে চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ্য হতে পারছি না। ”

তিনি জানান, বর্তমানে বিল্‌স তাদের চিকিৎসা দিচ্ছে।

তিনি সরকারের কাছে শ্রমিক আইন অনুযায়ী পাথর ক্রাশিং মেশিন মালিকদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়ার দাবি জানিয়ে মানুষ মারা এসব কারখানা বন্ধে অবিলম্বে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানান।

সিলোকোসিস রোগে মৃত শ্রমিক আমিরুল হকের বড় ভাই মোজাম্মেল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমিরুলের গচ্ছিত বলতে কিছুই নেই। চিকিৎসায় সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে। অন্যের ভিটেমাটিতে খড়ের ঘর তুলে ছিল। একটা ছেলে সেটাও ছোট। এখন আমিরুলের স্ত্রী আফিজান বেওয়া ছেলে আশরাফুল হোসেনকে (১৩) নিয়ে কিভাবে দিন গুজরান করবে-- কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ আমিই নিজের ৫ ছেলেকে নিয়ে এক বেলা খেতে পাই তো অন্য বেলা পাই না।

তের-চৌদ্দ বছর বয়সেই আশরাফুলকে সংসারের ঘানি ঘাড়ে নিতে হচ্ছে। অথচ এই বয়সে তার খেলাধুলা আর পড়াশুনা করার কথা। কিন্তু ওর ভাগ্যে সেই আনন্দের বিদ্যাপীঠে পড়া নেই। কারণ যে কারখানায় পেটের ভাত যোগাতে গিয়ে জীবন দিতে হলো বাবা আমিরুল হককে, এখন হয়তো সেরকমই কোনো কারখানায় শিশু বয়সে তাকে ছুটতে হবে নিজের ও সংসারের অন্যদের পেটের ভাত যোগাতে।

বাবার মৃত্যুর শোক কাটানোর আগেই আশরাফুলকে ছুটতে হবে কাজের জন্য।   অর্থা‍ৎ পরলোকগত পিতার জন্য ফেলা চোখের জল শুকোবার আগেই তা মিশে যাবে তার শরীর থেকে বের হওয়া ঘামে।

এ বিষয়ে জানতে চাইল নবগঠিত ৮নং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আছির উদ্দিন আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, “যে কারখানায় শ্রমিকরা পেটের ভাত যোগাতে গিয়ে জীবন হারাচ্ছে, এসব কারাখানা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি। কারখানাগুলো বন্ধ করা না হলে এ অঞ্চলে সিলোকোসিস রোগটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে। ”

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিল্‌স) এর গবেষণা ও তথ্য কর্মকর্তা আফজাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাথর গুঁড়া করার কাজে নিয়োজত শ্রমিকদের শরীরে সিলোকোসিস রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে কয়েকটি সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিল্‌স এসব শ্রমিকের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ মিনামূল্যে করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়েছে। তবে স্থানীয় শ্রমিকদের দেওয়া তথ্য মতে এ সংখ্য ৫৭ জনের বেশি।      

পাটগ্রাম উপজেলা হাসপাতালের কর্মকর্তা ডা. আনোয়ারুল ইসলাম সাজু বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে পাটগ্রামেই প্রথম সিলোকোসিস রোগ সনাক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি মারা যাওয়া মানু মিয়া ও আমিরুল হকসহ এ রোগে গত ৩ বছরে মোট ১৮ জন রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। তবে সিলোকোসিস রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই শতাধিক। এসব রোগীর চিকিৎসা জাতীয় বক্ষ্যব্যাধী ইন্সিটিটিউট ও হাসপাতালে রয়েছে। তবে এ রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের পক্ষ্যে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা মোটেও সম্ভব নয়।
 
বাংলাদেশ সময়: ২০৪১ ঘণ্টা, ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan.akraza@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।