হঠাৎ করে মনে পড়ল সুনামগঞ্জের কথা। হাছন রাজার টানে বহুবার ওখানে গিয়েছি।
বিকাল চারটার দিকে হোটেলে এসে উপস্থিত প্রদীপ। দু‘চার কথা হতেই প্রদীপকে বললাম, বর্ষায়তো হাওর-বিল জলে থৈ থৈ করছে। তাই এ সময় ৩/৪ দিন হাওরে নৌকায় ভেসে বেড়ালে কেমন হয়? কথাটা শুনেই প্রদীপ আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল, বাহ নদীতে ভেসে বেড়াব, রাতে নৌকায় ঘুমাব।
প্রদীপ সুনামগঞ্জের ছেলে। ওর বাবা আমার ঘনিষ্ঠজন। পরদিন হাছন রাজার সমাধিসৌধ, সংগ্রহশালা দেখে সুরমা নদী তীরে এলাম। নৌকা ছেড়ে দিল।
নদী দেখছি- বাহ্ কতই না রূপসী সুরমা নদী। প্রদীপই নদী থেকে জল উঠিয়ে দুই চোখে ছিটিয়ে দিয়ে বলল, সুরমার চেয়ে সুরমা নদীর জল কম তো আকর্ষণীয় নয়।
কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল উত্তরে মেঘালয়ের পাহাড় আর পাহাড়। প্রদীপ, আমি আর মাঝি এরফান আলী এ তিনজন নৌকায়। নদীর অথৈ জল আর দু’কূলের দৃশ্য দেখতে দেখতে সুনামগঞ্জ থেকে আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি।
বার বার চোখে পড়ছে তীরের গাছপালা, গরু-মহিষ নিয়ে বসে আছে রাখাল। আরেক দিকে জলরাশি দূরে বহু দূরে দেখা যাচ্ছে পাল তোলা নৌকা। এগিয়ে চলছে নৌকা। মাঝি এরফান গান ধরলÑ ‘ভাটির গাঙ্গে ভাইটাল সুরে বাঁশি কে বাজাইয়া যাও ওরে বন্ধুÑ একবার চাও ফিরে। ’
গানটা শেষ হতেই দেখি এক তরুণী কলসি কাঁখে নদীর ঘাটে এসে জল ভরছে। মুগ্ধ নয়নে তরুণীটিও হয়তো নদীর রূপ দেখছিলেন। তখন বার বার মনে হল সুনামগঞ্জের হাওরের রূপের কী আর তুলনা হয়।
প্রদীপ বলল, আমাদের সুনামগঞ্জ হল হাওরের শহর। বোরো ধানের জেলা শুধু নয় এ সুনামগঞ্জ আউল-বাউলের জেলা।
সুনামদি নামে এক সৈনিকের নাম থেকে হয়েছে সুনামগঞ্জ নামটি। এ কথা শুনে মাঝি এরফান বলল, না তা নয়। সুনামদি নামে এক জেলের নাম থেকে হয়েছে ‘সুনামগঞ্জ’। কথাটা শুনে প্রদীপ উচ্চবাচ্য করল না।
প্রদীপের মুখে আরও শুনলাম সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান হল মাটির মসজিদ, টেকের ঘাট খনি প্রকল্প, হাছন রাজার বাড়ি, গৌরাঙ্গ জমিদার বাড়ি, সুখাইর রাজবাড়ি।
দেখে দেখে আঁখি না ফেরে চারদিকের নির্জনতা।
পানির নিচে গাছপালার অর্ধেকাংশ ডুবে আছে। গাছে পাখি। একটা পাখি উড়ে এসে পড়ল জলে। দেখি একটা মাছ মুখে নিয়ে উড়াল দিল। হঠাৎ মাঝি এরফান বলল, দেখুন-দেখুন ওই যে চিল উড়ে যাচ্ছে।
বিকাল হয়ে এসেছে। নৌকা এক ঘাটে এনে রাখল এরফান মাঝি। বলল, একটু এগুলেই সাচনা বাজার । চাল তো আছে, কৈ মাছ পেলে কেটে-কুটে নিয়ে আসবেন। আমি ও প্রদীপ নেমে এলাম। প্রদীপ বলল, সুরমার পরেই হাওর। অনেক রাতে হাওরে গিয়ে নৌকা পড়বে। তখন খুব ভালো লাগবে।
রাত ৯টা পর্যন্ত সাচনা বাজার ঘাটে নৌকা বাঁধা ছিল। মাঝি এরফান বলল, রাত ১০টার পর নৌকা হাওরে ঢুকবে। তখন ভয় পান না যেন। হাওরের অপর পাড়ে কত না গ্রাম-জনপদ। প্রদীপ ও আমি পাশাপাশি শুয়ে আছি।
চাঁদের আলোতে দেখছি কত না কলার ভেলা ভেসে যাচ্ছে। তখন তো মনে পড়ল বেহুলার কথা। লখিনদরের মরদেহ নিয়ে তিনি কলার ভেলায় ভেসে ভেসে গিয়েছিলেন মনসার কাছে।
রাতে ঘণ্টা তিনেক ঘুম হয়েছিল। সকালে এসে পৌঁছলাম জামালগঞ্জে। মনে হল গোটা জামালগঞ্জ যেন অথৈ জলে ভাসছে। এদিকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামায় নৌকায় বসে রইলাম।
বৃষ্টি কমে যাওয়ার পর নেমে এলাম জামালগঞ্জ উপজেলা শহরে। হাটবাজার, উপজেলা পরিষদ, স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্য কমপে¬ক্স দেখে এক চায়ের দোকানে এসে বসলাম। চা দোকানদার বলল, গরুর খাঁটি দুধ আছে খাবেন নাকি। প্রদীপ বলল, দুই গ্লাস দিন।
দুপুর পর্যন্ত কাটালাম জামালগঞ্জে। একটি হোটেলে বসে কৈ আর শিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলাম বড় তৃপ্তি সহকারে। প্রদীপ বলল, ঢাকায় গিয়ে এমন কৈ আর শিং মাছ কী খেতে পারবেন। কথাটা শুনে ওর মুখপানে তাকিয়ে রইলাম।
রাত ১১টায় নৌকা ছেড়ে দিলÑ ফিরে যাচ্ছি সুনামগঞ্জের দিকে। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল বলে ঘুমটা ভালোই হল।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। মাঝি এরফারেনের কণ্ঠে ‘নিভিয়া ছিল মনের আগুন জ্বালাইয়া গেলে প্রাণ কোকিলারে- আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে’ গানের কথা শুনে।
সকাল হতেই তাকিয়ে দেখি সুরমার এক পাড়ে কাশবন বাতাসে দুলছে তখন মনে হল এরা বুঝি শরৎকালকে স্বাগত জানানোর জন্য সেজেগুজে বসে আছে। বাহ- কত না সুন্দর সুনামগঞ্জের গাঁও-গেরামের রূপ।
বাংলাদেশ সময় : ২০২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১২
সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর
kumar.sarkerbd@gmail.com