ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সিনেমাকেও হার মানায়!

সোনাগাছির অন্ধকার থেকে সুখের সংসারে...

ফিচার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪:০৬, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১২
সোনাগাছির অন্ধকার থেকে সুখের সংসারে...

জীবনের সঙ্গে সিনেমার চিত্রনাট্যের মিল ঘটে যায় কখনও কখনও। কিন্তু এ যেন সিনেমার সঙ্গে মিলে গেল জীবন।

গত ২ আগস্ট কলকাতায় বিক্রম অাগরওয়াল (ছদ্মনাম) আর মানালি সিংহের (ছদ্মনাম) বিয়ের আসরে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের অনেকেরই মনে এই কথাটা উঁকি দিয়েছে।

নিজের বাবা-মা জোর করে যৌনপেশায় ঢুকিয়েছিলেন নাবালিকা মেয়েকে। কিন্তু সেই পেশার সূত্রেই ঘটে গেল প্রেম, দুঃস্বপ্ন বদলে গেল মাধুর্যে। প্রেমিকের হাত ধরে যৌনপল্লি থেকে পালিয়ে গেলেন মানালি। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল ক’দিন বাদে। শ্বশুর-শাশুড়িও বৌমাকে সাদরে কাছে টেনে নিলেন। মানালির দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে তার নিজের (!) বাবা-মাকে।

যৌনকর্মীর সঙ্গে গ্রাহকের প্রেম ও পরিণয় হিট সিনেমার জনপ্রিয় ফর্মুলা। কিন্তু সঞ্জয় দত্ত-পূজা ভট্টের ‘সড়ক’, বিনোদ খন্না-মাধুরী দীক্ষিতের ‘দয়াবান’ কিংবা সালমান-নাগমার ‘বাগি’ নামের সুপারহিট ছবির সবগুলোই যেন ফিকে হয়ে গিয়েছে বিক্রম-মানালির গল্পের কাছে।

কীভাবে যৌনপল্লিতে এসে পড়েছিলেন মানালি? লালবাজারের নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ দফতরের অফিসাররা জানালেন, মানালির মা ছিলেন আগ্রা ঘরানার বাঈজি। আগ্রাতেই থাকতেন। মানালি অবশ্য মানুষ হয়েছেন মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদে, দাদু-দিদার কাছে। সেখানেই মাধ্যমিক পাশ করেন। সতেরো বছর বয়স হতে বাবা-মা তাকে প্রথমে আগ্রায়, তারপর সেখান থেকে জোর করে সোনাগাছিতে নিয়ে আসেন। মানালি বলেন, “কাঁদতে কাঁদতে মায়ের হাতে-পায়ে ধরে বলেছিলাম, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। ’ লাভ হয়নি। ”

সোনাগাছির জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছিল নাবালিকা মানালির কাছে। জোর-জবরদস্তির সীমা ছিল না। “খরিদ্দারের কাছে যেতে না-চাইলে বাবা গুণ্ডাদের দিয়ে মারধর করাত। ওরা সবসময় পাহারা দিত আমাকে। রোজগারের সব টাকা নিয়ে নিত। ” এভাবে পাঁচ মাস কাটার পর কাহিনীতে বিক্রমের প্রবেশ।

বিক্রমের বয়স তিরিশ ছুঁই-ছুঁই। মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। নিজে শেয়ার বাজারের কাজকর্ম করেন। খরিদ্দার হিসেবেই গিয়ে পড়েছিলেন মানালির কাছে। মানালি সেই রাতের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, “আমি কাঁদছি দেখে বিক্রম আমাকে স্পর্শ করেনি। সারারাত ধরে আমার কথা শুনেছিল শুধু!”

‘দয়াবান’ ছবিটার কথা মনে পড়তে পারে এ ঘটনায়। ‘দয়াবান’-এর নায়ক বিনোদ খন্নাও যৌনকর্মী মাধুরীর পরদিন পরীক্ষা রয়েছে শুনে সারারাত পড়তে দিয়েছিলেন। স্পর্শ পর্যন্ত করেননি। আর বাস্তবের সোনাগাছির ঘটনায় ওই রাতে মানালির মনে হয়েছিল, মানুষটি আলাদা ধরনের। আর পাঁচজনের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল।

এরপর থেকে বিক্রম প্রায়ই আসতেন। ভালবাসার সেই শুরু। প্রথম যেদিন মানালির কাছে গিয়েছিলেন, সেদিন গিয়েছিলেন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। মানালিকে জানিয়েওছিলেন সেটা। “বিক্রম আমাকে বলেছিল, ও বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিল। ” কিন্তু তারপর মানালির সঙ্গে দেখা করতেই ওপাড়ায় যেতেন তিনি। ‘সদমা’ ছবিতে শ্রীদেবীর অবস্থা দেখে থাকতে না-পেরে তাকে নিয়ে যৌনপল্লি থেকে পালিয়েছিলেন কমল হাসান। মানালিরাও পালালেন একদিন।

কী ভাবে? মানালি বলেন, “বিক্রম আমাকে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নম্বর জোগাড় করে এনে দেয়। তারপর পাড়ার গুণ্ডদের টাকা দিয়ে মদ খেতে পাঠিয়ে দেয়। সেই ফাঁকে ভোরবেলা ২২ নম্বর দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে পালাই। ”

তারিখটা ছিল, চলতি বছরের ২১ মার্চ। সোনাগাছি থেকে সোজা রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এ ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অফিসে চলে গিয়েছিলেন মানালি। সেখান থেকে লালবাজার। সেখানে মানালি নিজেই বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। ওদের গ্রেফতার করা হয়। এখনও তারা জেল হেফাজতেই রয়েছেন। লালবাজার থেকেই মানালিকে বেহালার একটি হোমে পাঠিয়ে দেয় রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি’-র (সিডব্লিউসি) কলকাতা শাখা।

চমকের শুরু তারপরে। মানালির আঠারো বছর বয়স হতে তখন চার মাস বাকি ছিল। বিক্রম এক দিন বাবা-মা-ভাই সবাইকে নিয়ে চলে এলেন সিডব্লিউসি-র অফিসে। পরিবারের সবাই অফিসারদের জানালেন, ছেলের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে মানালিকেই তারা বাড়ির বউ করতে চান। ২৭ জুলাই মানালির আঠারো বছর পূর্ণ হল। ওই দিনই বিশেষ বন্ড দিয়ে তাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে গেলেন বিক্রম আর তার মা-বাবা।

ঠিক পাঁচ দিন পর, ২ অাগস্ট ধুমধাম করে আত্মীয়-স্বজন ডেকে মানালির সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিল অাগরওয়াল পরিবার।

নাগেরবাজারের শ্বশুরবাড়িতে এখন জমিয়ে সংসার করছেন মানালি। তাকে জড়িয়ে ধরে শাশুড়ি বলেন, “এমন বৌমা ক’জন পায়? হাতে ধরে রান্নাবান্না শেখাচ্ছি। ” কিন্তু সমাজ যদি আঙুল তোলে? ষাট পার করা অাগরওয়াল গৃহিণীর দৃপ্ত জবাব, “বাচ্চা মেয়েটা নতুন করে বাঁচছে, তাকে অসম্মান করার ক্ষমতা কারও নেই!”

সোনাগাছি এলাকাতেই প্রায় ১৭ বছর কাজ করছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের কর্মী মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় জানালেন, এ রকম আরও দু’টি ঘটনার কথা মনে পড়ে তার। একজনের বিয়ে হয়েছিল সরকারি বীমা সংস্থার কর্মীর সঙ্গে। আর একজনের বিয়ে হয় এক উকিলের সঙ্গে। এই মহিলার আগের পক্ষের দুই মেয়েও ছিল। মেয়ে দু’টিকেও তার নতুন স্বামী মেনে নিয়েছিলেন, কাছে রাখতে দিয়েছিলেন।

মানালি-বিক্রমের জীবনও সুখ-শান্তিতে ভরে উঠুক, এমনটাই এখন চাইছেন সবাই। দিওয়ালির পরে বিক্রমের সঙ্গে মুম্বাই চলে যাওয়ার কথা মানালির। ওর এখন একটাই চিন্তা, “আমার বাবা-মা টাকা পয়সা দিয়ে কোনওভাবে ছাড়া পেয়ে যেন বিক্রমের ক্ষতি না-করতে পারে!”

সৌজন্যে: দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।