চট্টগ্রাম থেকে: সমুদ্র পাড়ের ফটোওয়ালাদের সঙ্গে দেখা হলো সমুদ্র পাড়েই। হাতে নানা ভঙ্গিমায় তোলা ছবির লেমিনেটেড কপি।
শত-শত মানুষ আসে সমুদ্র দেখতে। নিজেদের সঙ্গে থাকা ক্যামেরার বাইরে তারা চটজলদি ছবি তোলান এইসব ছবিওয়ালাদের দিয়ে। এর সুবিধা হল প্রিন্ট তারাই করে দেয় এবং তা পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গেই। ছোট্ট সস্তা ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয় ‘দামি মুহূর্তের’ ছবি। ছবি তোলার পর দ্রুত ক্যামেরা বা মেমোরি কার্ড নিয়ে ছবিওয়ালা ছোটেন পাশের স্টুডিওতে। প্রিন্ট হয়। কড়কড়ে ছবি নিয়ে মানুষ ফেরে ঘরে।
ছবির দাম ২৫-৫০ টাকা। সাইজ থ্রি আর, ফোর-আর। খদ্দের বুঝে দাম বাড়ে। ছবি’র ধরনের ওপরও দাম ওঠা-নামা করে। পেছনে সমুদ্র রেখে সমুদ্রপাড়ের সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে তোলা ছবি আর পাড়ে ফেলে রাখা বড় বড় পাথরের ওপর, যেখানে সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ে সমুদ্র বিলাসীদের পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয়, সেই আনন্দমুখরতার ছবি তোলার মধ্যে পার্থক্য যেমন রয়েছে তেমন তার জন্য ফটোওয়ালাদের দরেও রয়েছে হেরফের।
কেউ কেউ স্পিডবোট ভাড়া করে সমুদ্রের ঢেউ উপভোগ করতে চান। কেউ দূরে জাহাজে উঠেও ছবি তুলতে চায়। উথাল-পাথাল সেই ঢেউ দোলানো বোটে বসা ছবি তুলতে ঝুঁকি বেশি। দরও বেশি।
ফটোওয়ালাদের পক্ষ থেকেও থাকে নানা অফার। এজন্য তাদের কিছু খোঁজ খবরও রাখতে হয়।
প্রেমিক প্রেমিকারা একটু নিরিবিলি জায়গা চান। পাথরের আড়াল এই রকম। আমরা সেসব জায়গা চিনি। আগ্রহীদের অফার দেই রাজি হলে নিয়ে যাই। তখন তারা একটু অন্তরঙ্গ ছবি তোলান সমুদ্র পাড়ে, এতে দরটা একটু বেশি। বলছিলো মঈনুদ্দিন। বয়স ১৫। দেখতে বাচ্চা তবে কথাবার্তায় ইঁচড়েপাকা।
মঈনুদ্দিনের দিনে গড় আয় ৩০০ টাকা। কোনো দিন ৫ শ’- হাজারও ছাড়িয়ে যায়। কাজ বুঝে দাম।
মঈনুদ্দিনের মতো তিন শতাধিক ফটোওয়ালা রয়েছে পতেঙ্গার সমুদ্র পাড়ে। বয়স ১২-১৩ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ পর্যন্ত। প্রত্যেকেরই দিনে গড় আয় ৩০০ টাকার মতো।
মঈনুদ্দিনের লেখাপড়া তৃতীয় শ্রেণীতেই সমাপ্ত। লেখাপড়া এগুতে না পারলেও ক্যামেরায় ক্লিকটা শিখে নিয়েছে। তাতেই ভরসা করে নেমেছে জীবিকা অর্জনে। সোহেল নামের আরেক ছবিওয়ালা জানালো এইএসসিতে ‘ফেল মেরে’ তার এই পেশায় নামা।
কাস্টমারের আগ্রহ বোঝে তারা। কোন কাস্টমার ছবি তোলাবে, কে তোলাবে না সেটাও এখন দেখলেই বুঝতে পারে। যারা ক্যামেরা নিয়ে আসে তাদেরও বোঝানোর চেষ্টা করে। ছবি তুলে তা দ্রুত প্রিন্ট করা হবে সেই আগ্রহে ক্যামেরা নিয়ে আসলেও অনেকেই ছবি তোলান তাদের দিয়ে।
আমরা ছবি তুলবো তা আপনাদের চেয়ে অনেক ভালো হবে, বললো আত্মপ্রত্যয়ী জাকির। কাঁধে একটি স্প্যানিশ গিটার। গিটারে টিউন হয়? জানতে চাইলে কিছুই বুঝতে পারলো না। গিটার এই জন্য যে, এটি হাতে নিয়েই কেউ আইউব বাচ্চু, কেউ অ্যান্টোনিও ব্যান্ডেরাস এর ভঙ্গিতে সমুদ্র পাড়ে ছবি তোলে।
এভাবেই দিনভর চলে ছবিওয়ালাদের ব্যস্ততা।
জানালো এখানে তাদের তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। বলা যায়, স্রেফ বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবসা। ক্যামেরা ও অন্যান্য সামগ্রী যেমন গিটার, হ্যাট, ফুল এসবই স্টুডিওওয়ালার। ওগুলো তাদের বিনিয়োগ। বিনিময়ে যত ছবি তোলা হবে তা তাদের স্টুডিও থেকেই প্রিন্ট করানো হবে। ছবি প্রিন্ট বাবদ সাইজ বুঝে ১০ থেকে ১২ টাকা পড়ে। ছবিওয়ালাদের লাভ বাকিটা।
এভাবেই চলছে পতেঙ্গা পাড়ের ছবিওয়ালাদের জীবন। শুক্রবার বলে খুব একটা কথা বলতে রাজি হলেন না তারা। তবে তাদেরই একটি ছবি তোলা হবে, শুনে অনেকেই জড়ো হলেন, দাঁড়ালেন বিভিন্ন পোজে।
জাহাঙ্গীর নামে একজন বললেন, সারাক্ষণ আমরা অন্যের ছবি তুলি। এই প্রথম আমাদের ছবি কেউ তুললো। এতক্ষণে তারাও জানতে পারলেন তারা সাংবাদিকের পাল্লায় পড়েছেন।
বাংলাদেশ সময় ১১২৪ ঘণ্টা, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর