ঢাকা, সোমবার, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ২১ জুলাই ২০২৫, ২৫ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

কিশোর মহাপ্রয়াণের সিকি শতাব্দী

কখনও বলো না ‘বিদায়’!

রাইসুল ইসলাম, ফিচার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:০৬, অক্টোবর ১৩, ২০১২
কখনও বলো না ‘বিদায়’!

‘পাল পাল দিল কে পাস তুম রাহেতে হো’, কিশোর কুমারকে স্মরণ করতে গেলে হয়তো তার গাওয়া গানের এই চরণটিই প্রথম অনুরণন তুলবে যে কোনো কিশোর ভক্তের হৃদয়ে।

২৫ বছর আগে ১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর ধরাধাম ত্যাগ করেও এখনও ভারতীয় সঙ্গীত ইতিহাসের অন্যতম প্রধান আলোচিত চরিত্র হিসেবে রয়ে গেছেন খ্যাতিমান এ গায়ক।

মৃত্যুর আগে টানা চল্লিশ বছর নিজের গায়কীতে বিমোহিত করে রাখেন শ্রোতাদের।

স্বাধীন ভারতে সারা উপমহাদেশকে আলোড়িত করেছিলেন বলিউডকেন্দ্রিক তিন জন গায়ক। তাদের মধ্যে মুকেশ ও মোহাম্মদ রফি বিদায় নেওয়ার পর সর্বশেষ কিশোরের মৃত্যু অবসান ঘটায় ভারতের সঙ্গীত ইতিহাসের সবচেয়ে স্বর্ণালী সেই অধ্যায়ের। যে সময় স্মরণে এখনও রোমাঞ্চিত ও আলোড়িত হয় উপমহাদেশের সঙ্গীতপিপাসু আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা।

মধ্য প্রদেশের খান্দোয়ায় ১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন আভাস কুমার গাঙ্গুলি। বড় ভাই অশোক কুমার চেয়েছিলেন ছোট ভাই হবে তার মতই অভিনেতা। কিন্তু তরুণ কিশোরের আজন্ম লালিত সাধ ছিলো সঙ্গীত শিল্পী হওয়ার।

তার জবানিতে, “আমি শুধু গান গাইতেই চেয়েছিলাম, অভিনয় করতে নয়। ” যদিও অশোক কুমার অভিনীত ছবিতে প্রথম তাকে কয়েক লাইন গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন শচীন দেব বর্মন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গায়ক হিসেবে তার প্রথম অভিষেক হয় ‘জিদ্দি’ ছবিতে খেমচাঁদ প্রকাশের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘মারনে কি দুয়া কিউ মাঙ্গু’ গানের মাধ্যমে।

কিশোর ছিলেন খ্যাতনামা অভিনেতা ও সঙ্গীত পরিচালক-গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের একজন উন্মাদপ্রায় ভক্ত। এমনকি তার গায়কী ভঙ্গি নকল করারও চেষ্টা করতেন তিনি। কিন্তু আরেক সঙ্গীত ওস্তাদ শচীন দেব বর্মন তাকে উপদেশ দেন অপরকে অনুকরণ বন্ধ করে নিজস্ব গায়কী ভঙ্গি সৃষ্টি করতে।

মজার ব্যাপার হলো পরবর্তীতে কিশোরের গাওয়া বিখ্যাত অধিকাংশ গানই শচীন দেব বর্মনের সুর করা। এই তালিকায় আছে ‘পেইং গেস্ট’ ছবিতে ‘মানা জনাব নে পুকারা নেহি’, ‘নাও দো গেয়ারা’ ছবির ‘হাম হে রাহি পেয়ারকি’, ‘গাইড’ ছবিতে ‘গাতা রাহে মেরা দিল’ ‘জুয়েল থিফ’ ছবিতে ‘ইয়ে দিল না হোতা বেচারা’ এবং এরকম আরও অসংখ্য গান, যা আজও আন্দোলিত করে শ্রোতাদের হৃদয়-মন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে ওপরের সবকটি গানেই কিন্তু ঠোঁট মিলিয়েছেন বলিউডের চিরসবুজ অভিনেতা দেব আনন্দের অভিনীত ছবিতে গাওয়া। এ কারণেই আলাদাভাবে কিশোর কুমারকে ভালোবাসতেন দেব আনন্দ। এ প্রসঙ্গে দেবের মন্তব্যটি ছিল, “আমি রফির গান পছন্দ করি, কিন্তু কিশোরের গান আমার সঙ্গে যেনো বিশেষভাবে খাপ খেয়ে যায়। ”

যদিও ষাটের দশকেই তারকা খ্যাতি পেয়ে যান কিশোর কুমার, তবে ৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া আরাধনা ছবি তাকে নিয়ে যায় সফল্যের এক অনন্য স্তরে, যা অতিক্রম করা অনেকের পক্ষেই দুঃসাধ্য।

বিখ্যাত পরিচালক শক্তি সামন্তের পরিচালনা এবং রাজেশ খান্না অভিনীত এ ছবির গানগুলো শুধু মানুষের মুখে মুখে ফেরেনি, এর বদৌলতে উপমহাদেশের প্রথম সুপারস্টারের তকমা লাগে অভিনেতা রাজেশ খান্নার গায়ে।

জীবনে অনেক ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পেলেও কিশোর তার প্রথম ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারটি পান আরাধানাতে ‘মেরে সপ্নে কে রানি তু আয়েগি কব’ গানটি গেয়ে। এরপরে পুরো সত্তরের দশক তো পুরো উপমহাদেশকেই মাতিয়ে রাখেন শচীন পুত্র আরডি বর্মন (পঞ্চম) ও কিশোর কুমার জুটি। পঞ্চমের সুর আর কিশোরের কণ্ঠ ঘুচিয়ে দেয় সাংস্কৃতিক পার্থক্য, বয়সের ব্যবধান, ‍সৃষ্টি করে ভারতের সঙ্গীত ইতিহাসের সবচেয়ে স্বর্ণালি অধ্যায়ের।

আরেক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক জুটি লক্সীকান্ত-পেয়ারেলালের সঙ্গেও কিশোর উপহার দেন হিন্দি গানের ইতিহাসের চির সবুজ অনেক গান। ‘মি. এক্স ইন বোম্বে’ ছবির ‘মেরে মেহবুব কেয়ামত হোগি’, ‘দো রাস্তে’ ছবির ‘মেরি নাসিব মে আয় দোস্ত’, ‘দোস্ত’ ছবির ‘গাড়ি বুলা রাহি হ্যায়’— প্রত্যেকটি গানই তো সুপারহিট।

এছাড়া রাজেশ রোশানের ছবিতে গাওয়া কিশোর কুমারের সেই গানগুলো, ‘জুলি’ ছবির ‘দিল কেয়া করে জব কিসিসে কিসিকো কো পেয়ার’, ‘ইয়ারানা’ ছবির ‘ছু কে মেরে মান কো’ আজও তো নতুন মনে হয়।
কিশোর কুমারই ভারতের একমাত্র পুরুষ গায়ক যিনি আটবার শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মৃত্যুর সিকি শতাব্দী পার হয়ে গেলেও যে রেকর্ড অম্লান আছে আজও।

সত্যজিতের প্রথম পছন্দ ছিলেন কিশোর কুমার। সত্যজিতের ‘চারুলতা’ ছবির ‘ওগো বিদেশিনী’ গানটি তো আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

কিশোর কুমারের মেধা শুধু গায়কীতেই প্রমাণ হয়নি, একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন সুরকার, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক ও পরিচালকও। এছাড়া চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন তিনি।

১৯৮৫ সালে কর্মজগত থেকে অবসর নেন সবার প্রিয় কিশোরদা। মুম্বাই ত্যাগ করে খান্দোয়ায় নিজের মাতৃভুমিতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। অনেকে এই ইচ্ছাকে কিশোরের মৃত্যুকে বরণের আগাম প্রস্তুতি হিসেবেও মনে করে থাকেন।

এর মাত্র দুবছরের মধ্যেই মারা যান তিনি। শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার নিজবাসভূম খান্দোয়ায়। মাতৃসম জন্মভূমির নিভৃত কোলেই শেষ আশ্রয় হয় তার।

কিশোরের ‍মৃত্যুর পর কেটে গেছে প্রায় সিকি শতাব্দী। কিন্তু তার মত মহান আত্মাদের শেষ বিদায় ঘটে না। তাদের বিদায় দেওয়া যায় না। তাদের সুর থেকে যায় মানুষের হৃদয়ে, মনের মুকুরে, অন্তরের অন্তঃস্থলে।

কিশোর কুমাররা বয়সহীন, সময়হীন, মৃত্যুহীন। সময় তাদের ম্লান করতে ব্যর্থ, কাল তাদের গ্রাস করতে ভয় পায়।

কিশোর কুমারের মহাপ্রয়াণের ২৫ তম বার্ষিকীতে হয়তো এই গানটি তার স্মরণে সবচেয়ে যুতসই-

“চালতে চালতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ ‍রাখনা, কাভি আল বিদা না কাহে না” অর্থাৎ জীবন চলার পথে আমার এ গান মনে রেখ— কখনও ‘বিদায়’ কথাটি বলো না!

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩২ ঘণ্টা, ১৩ অক্টোবর, ২০১২
সম্পাদনা: রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর; আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।