ছেউরিয়া, কুষ্টিয়া থেকে : যেথা যাই মানুষ দেখি, মানুষ দেখে জুড়াই আঁখি...।
মানুষের মধ্যেই সৌন্দর্য, মানুষের মধ্যেইতো খোদা।
কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালনের বারামখানায় বুধবার দুপুরে কথা হয় মোহাম্মদ হাসেম সাধকের সঙ্গে। লালনের তত্ত্ব নিয়ে ভাবেন তিনি, ধ্যান করেন, জাগতিক-মহাজাগতিক বিষয়বস্তুর মধ্যে যোগসূত্র খোঁজেন, আত্মার সঙ্গে দেহের সর্ম্পক স্থাপন করেন। কিন্তু পারেন কিনা? সেটি ভাবের ব্যাপার।

কুষ্টিয়া শহরেই বাস হাসেম সাধকের, মিরপুর থানায়। এখন তার ভক্তরা আসছেন এখানেই। লালন স্মরণোৎসবের শেষদিন পর্যন্ত থাকবেন বলে জানান বাংলানিউজকে।
সারাদেশের প্রায় সব বাউলের আস্তানা এখন ছেঁউড়িয়া। আর যারা এখানে নেই, দেশময় ছড়িয়ে রয়েছে তাদের মনও হয়তো পড়ে রয়েছে লালনের বারামখানায়। কত রকমের সাধক-বাউল, কত বিচিত্র তাদের জীবন! অগণিত ভক্ত-অনুরাগী, বাউল, সাধু-বৈষ্ণব, ফকির-দেওয়ানের পদচারণে ভারী হয়ে আছে সাধুবাজার।
কারও গেরুয়া বসন, কারও ধূতি, কেউ কেউ পরেছেন আপাদমস্তক সাদা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। সাদা আলখাল্লা পরা শত শত ‘খেলাফতধারী’ সাধুর ভিড়ে অপার্থিব ও অভূতপূর্ব দৃশ্য লালনসমাধি চত্বরে এখন!
আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে বাউলরা ছেউড়িয়া আসা শুরু করেন। কেউ তাঁবু খাটিয়ে, কেউ বা খোলা আকাশের নিচে। মাঠজুড়ে মেলা আর ধোঁয়া।
একসময়কার সামরিক বাহিনীর সদস্য (গাড়ি চালক) হাসেমই এখন মোহাম্মদ হাসেম সাধক।
কিভাবে ‘লালন তত্ত্ব’র সান্নিধ্যে আসলেন? জানতে চাইলে বলেন, “বাবাজি আমি আগে বনপশু ছিলাম। কিছুই জানতাম না, অন্ধ ছিলাম। ”
“তবে কুষ্টিয়াতে আসলে এখানে আসতাম। সাঁইজির ছবি দেখলে ভালো লাগত, সাধুদের পাশে বসতে ভালো লাগত। একটু একটু শুনতে লাগলাম সাধুদের তত্ত্বকথা। দেখলাম ভালো লাগে। একসময় মনে হলো, আমিও মনে হয় উনাদের কথা বুঝতে পারছি। মনে হলো— মানুষের কথাই তো মানুষ বলছে। আমিওতো মানুষ। কিন্তু আমি কী করছি!”
আজ থেকে ৪০ বছর আগের ঘটনা। তখন হাসেমের বয়স ৩৪ বছর। সামরিকবাহিনীতে চাকরির ১২ বছরে পার হয়ে গেছে।
একসময় চাকরি ছেড়ে দেন হাসেম। নিজে নিজে ভাবতে থাকেন, ধ্যানে বসে, কখনো সাঁইজির দরবারে।
হাসেম সাধক বলেন, “একসময় ভাবি, ‘আওয়ালে বাওরাত’ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে মুক্তির পথ পাব না। সত্য মানুষের খোঁজ পাব না। সত্য মানুষের সন্ধানে থাকি। ”
“যতটুকু মনে পড়ে কোনও একরাতে হয়তো সাঁইজিকে স্বপ্ন দেখেছিলাম, এর মানে আমি যে সত্য মানুষরে খুঁজে বেড়াচ্ছি, সেই এসেছিল হয়তো, বা ভেবেছিলাম কেমন হতে পারেন তিনি। ”
সত্য মানুষের সন্ধানে থাকেন হাসেম। পরের বছরের পয়লা কার্ত্তিক চলে আসে। এক বন্ধুকে নিয়ে আখড়ায় আসেন তিনি। বলেন, “বন্ধুকে বলছিলাম, ওখানকার যে সাধকেরা আমারে বেশি দামে কিনতে চায় তুই আমাকে তার কাছে বিক্রি করে দিয়ে আসবি।
এখানে পাশাপাশি একটা হাসনাহেনা ও একটা বকুল গাছ ছিল। দেখলাম আমার সেই সত্য মানুষ আমার সাঁইঝি হাসনাহেনা ও গুরু মা বকুল তলায় বসে আছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে পকেটের সব টাকা সাঁইঝির সামনে ফেললাম। সেখানেই বসে পড়ি। বন্ধুকে বললাম, আমি বিক্রি হয়ে গেলাম। ”
হাসেম সাধু জানালেন, তার এই গুরু সাধকের নাম ছিল ফকির চান সাধক। তার দাদা গুরু ছিল আব্দুল শাহ। আব্দুল শাহের গুরু ছিল লালন শিষ্য পাঁচু শাহ। পরে ১৯৮৮ সালে হাসেমকে খেলাফত দেন চান সাধক।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভক্ত রয়েছে হাসেমের। জানালেন, “পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, ঢাকাসহ অনেক জেলাতেই রয়েছে ভক্ত। ভক্তদের বাড়ি বেড়াতে যেতে হয় মাঝে মধ্যে। ”
ভক্তদেরকে নিজের গুরুর শিক্ষাই পৌঁছে দেন সাধক। আত্মার মুক্তির পথ বাতলিয়ে দেয়া হয়।
আত্মার মুক্তি প্রসঙ্গে হাসেম সাধক বলেন, “ ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘money loss, something loss. But character loss, everything loss. কথাটা খুবই সত্যি। আপনি যখন চরিত্র হারিয়ে ফেলবেন, তখন আর কিছুই থাকবে না। এটাকে শক্ত করতে হবে। ”
“তবে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে, কু-প্রবৃত্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। কাম বাসনা ত্যাগ করতে হবে। মনকে শক্ত বাঁধে বাঁধতে হবে। মনে রাখবা বাবা, কাম হইছে ধ্বংসের মূল। এটার কারণে মানুষ কোথাও শান্তিতে থাকে না। এ কামই ধ্বংস করে। সারাদিন শুধু মাথার মধ্যে কামের চিন্তা!”
“সাধকদের কামবিমুখ হতে হয়। যে কামকে জয় করতে পারবে না, সে সাধক হতে পারবে না। ” আবারো ভাবের রাজ্যে চলে যান সাধক।
হয়তো সমাধান খোঁজেন তিনি। ভক্তরা এসে হাত মিলিয়ে যায়। কেউ প্রণাম করে, কেউ সালাম জানায়। বসে থাকেন ভক্তরা। তারাও চুপ করে থাকেন।
অনেক বাউল ভক্ত রয়েছেন হাসেম সাধকের। তারা এসে লালনের গান শোনান। নিজে গুন গুন করে গান। মর্মার্থ খুঁজতে থাকেন লালন দর্শনের।
এক সাধু থেকে তরিকা পায় আরেক সাধু। সেখান থেকে আরেক সাধু। তরিকা অনেক সময় এদিক সেদিক হয়ে যায়। কিন্তু মূল তরিকা এক, লালন।
পাশে বসা আব্দুল মালেক সাধুর সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, এটা ‘একের ঘরের অংক’। এখানে সবাই এক। তাইতো স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে চান ফকিরের শিষ্য হয়েছিলেন। দেশে দেশে ঘুরে গান করে বেড়ান। লালনের গান আর ভাব ছড়িয়ে দেন মানুষের মনে।
যেন আলগোছে গেয়ে ওঠেন মালেক সাধু—
“আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে,
দিব্যজ্ঞানী সে হয়েছে...”
বাংলাদেশ সময় ২২৪৪; ১৭ অক্টোবর, ২০১২
এমএন/সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan.akraza@gmail.com