সাঁইজি’র বারামখানা, ছেউরিয়া থেকে: “আসবার কালে কি জাত ছিলে, এসে তুমি কি জাত নিলে, কি জাত হবে যাবার কালে, সে কথা ভেবে বল না/ জাত গেল, জাত গেল বলে/ একি আজব কারখানা/ ব্রা’ন, চণ্ডাল, চামার, মুচি একজলে হয় সব হয় গো সুচি, দেখে শুনে হয় না রুচি/ জমে তো কাউকে ছাড়বে না/ জাত গেল জাত গেল বলে...
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়/ লালন বলে জাত কারে কয় সে ঘোরও তো গেল না/ জাত গেল জাত গেল বলে...”
গান থামে মালেক বাউলের। বলেন, “আমরা পুরুষ মানুষ হইলাম এনসানের জাত, আর মেয়ে মানুষ হইলো জ্বিনের জাত।
মালেক বাউলের মতে মনি থেকেই হয় সকল মানুষের সৃষ্টি। তিনি বলেন, “যেখান থেকেই উৎপত্তি সেখান থেকেই নিষ্পত্তি। সবই একই জায়গায়। ” এ কারণে সব জাত-ধর্মের ওপর মানুষকেই প্রাধান্য দিয়েছেন মালেক বাউল।
গত রোববার লালনের স্মরণোৎসবে যোগ দিতে কুষ্টিয়ার ছেউরিয়াতে এসেছেন আব্দুল মালেক সাধু। গত বুধবার বাংলানিউজর সঙ্গে কথা হয় সাঁইজির (লালন) বারামখানায়। জানান মানুষের এক ধর্মের কথা, এক জাতের কথা আর নিজের বাউল হয়ে ওঠার গল্প।
বয়স আমার ১২!
দেখে বোঝার উপায় নেই মালেক সাধুর বয়স ৮০। এখনো শক্ত, সামর্থ্য। তিনি বলেন, “বয়সে বাড়ছি, মনে বাড়ি নাই, বয়স আমার ১২। ”
৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় গ্রামে চাচার বাড়িতে প্রথম লালনের গানের একটি বই পড়েন মাদরীপুরের শিবচর থানার মালেক। সেটা ছিল ১৯৪৪ সাল।
বাউল বলেন, “গানগুলো পড়তে আমার ভাল লাগে। গানে আছে, কি কর্ম করিলে মানুষ অমর হয়, থেকে যাওয়া যায় পৃথিবীতে, এগুলো আমার মাথায় ঢুকলো একটু একটু আগ্রহ আরো বাড়ে। আরো কয়েকদিন চাচার বাড়িতে যেয়ে গানগুলো পড়া শেষ করি। ”
৩ বোন ১ ভাইয়ের সংসার ছিল মালেকের। বাবা মারা গিয়েছেন ছোট বেলাতেই। ১৫ বছর বয়সেই আধ্যাত্মিক চিন্তা প্রবেশ করে মাথায়। সে চিন্তা আর বের হতে চায় না। কূল কিনারা খুঁজে পায় না, সমাধান যেন লালনেই আছে, খুঁজে বের করতে হবে।
খোঁজ মনে হয় আজো পাইনি
বৈরাগী মালেক বলেন, “একবার গ্রামে আসলেন চান সাধু। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের খোঁজে বের হয়ে যাই সাধুর সঙ্গে। মানবাত্মার খোঁজ মনে হয় আজো পাইনি। পেলেও কি ধরে রাখতে পারি? আমি গুনাগার?”
১২ বছর ধরে শিষ্য ছিলেন চান সাধুর। এরপর গুরুর প্রয়ান ঘটল। কিন্তু গুরুর লালন দর্শন আর গুরুশিক্ষা রয়ে যায়— মালেক সাধুর চিন্তায় আর গলার দরাজ সুরে।
“সাধু বেচে থাকার সময়েই আমাকে বললেন, বিয়ে কর। বিয়ে না করলে সাধু হতে পারবি না। কামের জগৎ খালি টানবে। বিয়ে করি, ২ ছেলে জন্ম নেবার পর সাধু বললেন, এবার চলে আয়। তারপর থেকে কাম স্টপ রাখছি। ”
আজমিরে সাঁইকে বলে ‘লালন খাজা’
চান সাধুর সঙ্গে আজমির শরীফেও গিয়েছিলেন মালেক। এখনো যান প্রতিবছর। সেখানে খাজা বাবার অনুসারি ছিলেন। তবে লালনের দর্শন ও গানের চর্চা সেখানেও হয় বলে জানান তিনি। সেখানে লালন সাঁইকে বলে ‘লালন খাজা’। তারা চিশতিয়া তরিকায় চিন্তা ভাবনা করে।
কাম প্রবৃত্তি থেকেই কু প্রবৃত্তির উৎপত্তি বলে মনে করেন মালেন সাধু। বলেন, “পুরুষের শক্তি কেড়ে নেয় নারী। নারীর সামনে সব হার মেনে যাবে। সাধনার সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে কামকে ধরে রাখা। নিজের সম্পদ যদি হারিয়ে ফেল, সেটা তুমি আর পাবা না। মনের মধ্যে যদি কামের চিন্তা না আসে, দেহ সেইখানে সায় দিবো না। তুমি একরাত ধইরা নারীর সঙ্গে মিললেও তোমার বীর্য পড়বে না। ”
সাধু বলেন, “লালন ঘুমের মধ্যে জাইগ্যা থাকতেন। ঘুমের মধ্যেও কু-প্রবৃত্তি আসতে পারে। ডাকাতি হয়ে যেতে পারে সম্পদ। লালন বলছে, রতিকে সাধনা কর। আর এই রতি সাধনাই করছে সবাই। ”
প্রকৃতিকেও ছেড়ে দিতে পারবা না
সাধু বলেন, “দেহের সঙ্গে আত্মার যেমন মিল আছে, তেমনি প্রকৃতিকেও ছেড়ে দিতে পারবা না। আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, তীথি, আমাবশ্যা, পূর্নিমা, নক্ষত্র বুঝি না। কাম ওঠে যখন তখন। জন্ম নেয়, ল্যাংড়া, খোড়া শিশু। এই ভুল আমাগো নিজের লাইগ্যা। ”
“লালনতো সব বলেছেন। বলছে নিজের ধনে ধনী হও। আমরা মূল্য দিতে জানি না। ”
লালন বলেছেন, “যে ধনের উৎপত্তি প্রাণ ধন.../ সে ধনের হলো না কেন যতন?/ আকাশের ফল পাকায় লালন/ দেখে শুনে জ্ঞান হলো না...
সাধু বলেন, “নিজের মনেই ধন আছে, নিজের শরীরেই ধন আছে। সেটার যত্ন নিতে হবে। দেখে শুনেও যদি জ্ঞান না আসে, তবে সে অধম। ”
লালনের অংক এক ঘরের
খুলনার সুরেশ্বর পীরের মুরিদ সৈয়দ আহমদ আলম। কিন্তু লালন দর্শন আর গানের ভক্ত। বললেন, “জাতের হিসেব কে করতে পারে? দুনিয়া একটা ঘর। লালনের অংক এক ঘরের। নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব— এ ধরনের দুই ঘরের অংক এখানে নেই। ”
তিনি বলেন, “জাতে তো কিছু নেই, সবই সৃষ্টিতে আছে। সৃষ্টিতেই আছেন স্রষ্টা। শুধু স্বরূপ সাধন করতে হবে। লালন বলেছে, মানুষ ভোজিলে সোনার মানুষ হবি...”
বাংলাদেশ সময় ২২৫৪ ঘণ্টা, ১৮ অক্টোবর, ২০১২
এমএন/সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটরahsan.akraza@gmail.com