নারায়ণগঞ্জ: গত বুধবারের হালকা শীত শীত আবহে মোড়া রাতটিতে অন্যরকম এক উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে। এ জনপদের একসময়ে শাসক ‘বাংলার বার ভূঁইয়াদের’ প্রধান ঈশা খাঁকে এ রাতে উপস্থিত সুধীজনের সামনে তুলে ধরা হয় একটু অন্যরকমভাবে।
বর্ণিল আলোক সজ্জায় মঞ্চ ছাড়াই মঞ্জ নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল অন্য রকম একজন ইশা খাঁকে।

সোনারগাঁওয়ের লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁও যাদুঘর) এর ভেতরে ‘বড় সরদার’ এর বাড়িতেই মঞ্চস্থ করা হয় ‘ঈশা খাঁ’ যাত্রাপালাটি।
১ঘণ্টা ৫০ মিনিট ধরে চলা টানা যাত্রাপালা ছিল অকেটাই মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকদের বিহ্বলতায় উদ্ভাসিত। তাদের মুগ্ধ আর অপলক দৃষ্টি যেন নড়ছিল না যাত্রপালার দৃশ্যপট থেকে। তবে পারফর্মারদের অভিনয়শৈলীতে চমকিত দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি অনুষ্ঠানে বিরাজমান নান্দনিক গাম্ভীর্যে ছেদ টানছিল মাঝেমধ্যে। যাত্রাপালায় সাধারণত পাশ থেকে ডায়ালগ বলে দেওয়া হয়। আর কুশীলবরা তা শুনে তাই উচ্চ কণ্ঠে আউড়ে যান। কিন্তু বুধবার সে ধরনের কিছু ছিল না। তারবিহীন মাইক্রোফোন আর বর্ণিল আলোকসজ্জা ছিল নজরকাড়া। কুশীলবদের পাশ থেকে ডায়লগ পড়ে শোনাতে হয়নি। মুখস্থ বিদ্যায় অসাধারণ পারফম্যান্স দেখিয়েছেন সবাই টানা প্রায় দু’ঘণ্টার এ আয়োজনে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী যাত্রাপালার আয়োজক। তাদের দাবি, এটা হচ্ছে এক ধরনের নিরীক্ষা। সনাতন মঞ্চবিহীন এ ধরনের যাত্রাপালা আয়োজন সফল হওয়ায় তারা আশাবাদী, ভবিষ্যতে এ ধরনের আরোও উদ্যোগের বিষয়ে।
যাত্রাপালা অনুষ্ঠানের আগে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁও-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের এমপি আবদুল্লাহ আল কায়সার। এছাড়া অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নাট্যত্বত্ত ও চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক সারা আরা মাহমুদ, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক রবীন্দ্র গোপ প্রমুখ।
আলোচনায় লিয়াকত আলী বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে মঞ্চ ছাড়া যাত্রাপালা আয়োজন এটাই প্রথম। এটা এক ধরনের নিরীক্ষা। এটা সফল হলে বাংলাদেশের আরও অনেক স্থানে এ ধরনের যাত্রাপালা করা হবে। সারাদেশ থেকে শিল্পী বাছাই করে তাদেরকে দিয়ে যাত্রপালাসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান করা হবে। এজন্য ৬৪ জেলার সবগুলো উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমীকে সক্রিয় করা হবে। যাত্রার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। যাত্রাপালার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন ইতিহাসভিত্তিক প্রত্নত্বাত্তিক ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে আরও পরিচিত করা হবে।

ঈশা খাঁ যাত্রাপালার নির্দেশনায় ছিলেন মিলন কান্তি দে। যাত্রাপালা শেষে দেওয়া বক্তব্যে তিনি প্রশ্ন করেন, ফরিদা ইয়াসমিন যদি লালনগীতিকে প্রত্যন্ত জনপদ থেকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসতে পারেন তাহলে আমরা কেন যাত্রাকে সমৃদ্ধ করতে পারবো না?
তিনি আরও জানান, ২মাস ধরে রিহার্সেলের পর ঈশা খাঁ যাত্রাটি সফলভাবে করা হয়েছে। এটা ছিল এক ধরনের পরীক্ষা। সেটার মধ্যে আমরা উত্তীর্ণ হয়েছি।
সোনারগাঁও বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জল প্রাচীন জনপদ। এক সময়ে সোনারগাঁও জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সোনারগাঁও মধ্যযুগে ছিল মুসলিম সুলতানদের রাজধানী। তৎকালীন বার ভূঁইয়ার প্রধান ঈশা খাঁর আমলে সোনারগাঁও বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতির শীর্ষে আরোহরণ করে। আনুমানিক ১৫৭৫ সালে ঈশা খাঁ মোঘল সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মোঘল সুবেদার ইসলাম খানের সময়ে ১৬০৮ সালে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তরিক হওয়ায় সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব ম্লান হয়ে যায়।
তবে ঈশা খাঁর আমলে শাসন চিত্র ও সোনারগাঁও দখলে মোঘল সম্রাট আকবরের যুদ্ধ ঘোষণার চিত্র যাত্রাপালায় তুলে ধরা হয়।
যাত্রাপালায় অভিনয় করেন ২০জন কুশীলব।
বাংলাদেশ সময় : ১১৫৯ ঘণ্টা, ১৮ অক্টোবর, ২০১২
তানভীর/একে