২৩ অক্টোবর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেছেন মৃত্যুর মায়াতলা পেরিয়ে অনেক দূর।
ঢাকা শহর খালি।
বৃক্ষের সংসারে শোক। কি যেন এক শীত-অসারতা নেমে এসেছে। বিশাল এক বৃক্ষের সংসারে সন্তপ্ত মানুষদের দেখছি। একটা ডোবার উপর একখণ্ড আলো। কুনো ব্যাঙের বাচ্চারা খেলছে। পাড়ে কার অপেক্ষায় যেন দাঁড়িয়ে আছে একটা বৃক্ষ। ভাঙা একটা ডাল কাত হয়ে পড়ে আছে। পাতাগলো শুকনো। এতো কাঁচা পাতার ভিড়ে ওই ডালের পাতাগুলো শুকনো। দেখলেই বোঝা যায় দুটো পাতার মধ্যে মাকড়সা জাল বুনেছিলো। সেখান থেকে একটা পাতা ডোবার জলে পড়ো পড়ো। পাতাটার ওপরে একটা কাচপোকা প্রায় মৃত পাতা থেকে অন্য একটি পাতায় যাবার চেষ্টা করছে।
আমার লেখার এ খসড়াটি ডায়েরিতে দেখে সুনীলদা মানে সদ্য প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, অদ্ভুত এক চিত্রকল্প তো! মুগ্ধ হয়ে পড়তে পড়তে আবার স্বাতী বৌদিকে বললেন দেখোতো লেখাটা। লেখাটা ভালো কি মন্দ ছিলো সেটা কথা নয়। একজন প্রাজ্ঞ লেখক কীভাবে এক তরুণকে অনুপ্রাণিত করেন তার দৃষ্টান্তের কথা বলছি; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে কবে সুনীলদা হয়ে উঠেছিলেন তা আজ আর ঠিক মনে নেই। তবে আমার ক্যামেরায় তোলা তার যতো ছবি বা তার সঙ্গে আমার যতো ছবি আছে, সেগুলোর জামা-কাপড়ের বয়স দেখে মনে হয় অনেক দিন। অনেক বছর, অনেক আলোকবর্ষ পার হয়ে গেছে তাকে চেনার পর। হিরোশিমায় তখনো বোমা পড়েনি। ক্লাস্টার বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়নি ছবির দেশ বা ছবির মতো দেশ আফগানিস্তান।
বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির মাঝে বুদ্ধ পৃথিবীকে আশির্বাদ করছিলেন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধরা চড়াও হয়নি রোহিঙ্গাদের উপর। ইউএনও তখনো গেম দেখতে শুরু করেনি। রামু পটিয়া আক্রান্ত হয়নি তখনো। এর মধ্যেই সুনীলদা আমার আত্মীয়। এখন যেখানে তিনি বসত করছেন এ দূরত্ব কাউকে জানানো যায় না। কিছু বলা যায় না। এমনকি সুনীল আকাশের রঙও বোঝানো যায় না।
দিকশূন্যপুর... কাকাবাবু... কিম্বা নীরার শহরে যে মানুষটি বেঁচে ছিলো। তিনি আজ নেই। টানা রিক্সাঅলাটা কিন্তু যথারীতি বাজার টেনে যাচ্ছে। মোবাইলের দোকান থেকে রিচার্জ চলছে। সেই মানুষটি কোথায়... যিনি এতোদিন অভিভাবকের মতো জেগে ছিলেন। তিনি কি ঘুমন্ত? তাকে কেন কেউ ডাকছে না? শুকনো অনুভব নিয়ে রোগা একটা সকাল বিড়ি খাচ্ছে। আর গোলপার্কের মোড়ে যে মেয়েটির মুখে বিদেশি সিগারেট দেখেছিলাম... তার হাতের ডায়েরির পাতা আমার হƒদয়ের মতো। আমি প্রায় নির্বোধের মতো ঘুরছি... ভালো আর খারাপের দোলনায় চমক উড়ছে... আর যারা রাতশাসন করতো... যারা জীবনের ভূগোল বদলে দিতো... সেদিনগুলো যেন আজ ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। সুনীলদা হঠাৎ করেই চলে আসতেন ঢাকায়। তারপর দেখা করা। পত্রিকা অফিস থেকে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ঘুরতাম তার সঙ্গে। কতো কথা তার সঙ্গে! কেন কবিতা লেখি না -তার জিজ্ঞাসা থাকতোই। বলতাম কবিতার বিলে বাঁচা যায় না। তিনি কবিতা লেখেন না কেন জিজ্ঞেস করতেই বলতেন আমি নিয়মিত লেখি। তোমরা পড়াশোনা কমিয়ে দিয়েছো। কবিসত্তা সহজ নয়। সবার মধ্যে থাকে না। বিত্ত বৈভবের মধ্যে কবিতা ভালো থাকে না। তিনি আসলেন একবার হুমায়ূন আহমেদের ‘ জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প বইয়ের মোড়ক উম্মোচন করতে। আমার দায়িত্ব ছিলো তার সঙ্গে থেকে পত্রিকার জন্য একটা ইন্টারভিউ করা। সেটা করতে করতে অনেক গল্প। এর একটা গল্প বলছি- যে কোনো কারণে বাসায় ফেরার টাকা নেই। তাই তার লেখক বন্ধুরা মিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গাড়ি থামিয়ে টাকা চাইছিলো বাড়ি ফেরার জন্য। বৌদির সঙ্গে তখন প্রেম চলছে। কবিতা লেখে, মাথাটা বড়ো, টিনটিনে দেহ অবার মদ খেয়ে পড়ে থাকে এখানে-ওখানে। সারা জীবনে বউকে খাওয়াতে পারবে না। মদ খাবে না বউকে খাওয়াবে (সুনীলদা সম্বন্ধে এটা ছিলো তার এক বোনের কথা বা পরিবারের অভিমত)? সুনীলদার পা টলছে কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে এভাবে একটা গাড়ি থামালেন। বললেন বাড়ি যেতে পারছি না, ভাড়ার টাকা নেই, ক’টা টাকা দিন না। ভাগ্যও এমন ওই গাড়িতে ছিলো বউদি ও তার বড় বোন। বড় বোন গাড়ির কাচ নামিয়ে মুখ বের করে বললেন, ‘’ও আজকাল এই করেই খাওয়া হয় নাকি?’’
সেই দিন আজ ফ্রেমে বাঁধানো স্মৃতি। তবু কার্নিশ পেরোনো বিড়ালের থাবাচাটা শব্দ শুনতে শুনতে মনে হয় - জীবন এত ছোট কেনে? ঢাকা শহরে এখন শীত-অসারতা নেমে এসেছে। যৌন ব্যবসায়ীরা বেকার। ওরা খাবে কী? চে’র মৃত্যুতে অপরাধী কবি এ ভাবনাও ভাবতেন। দৃশ্যকল্প থেকে দৃশ্য হারিয়ে যায়। তার উপন্যাসের ইতিহাস সচেতনতা আলোর পথযাত্রার নির্দেশ দেয়। কখনো দিকচিহ্নের মতো কাজ করে। ‘ঠাকুর বনাম টেগোর` শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘‘বিদেশিদের ঠাকুর উচ্চারণ করতে অসুবিধে। আমরা যদি শেক্সপিয়র কিংবা গ্যেটে উচ্চারণ করতে পারি, তা হলে ওরা কেন ঠাকুর বলতে পারবে না? এমন তো কিছু শক্ত নয়। তবে, হয়তো খুব দেরি হয়ে গেছে। এখন টেগোরের বদলে ঠাকুর দেখলে অনেকে হয়তো চিনতেই পারবে না। ’ সুনীলদা আনন্দবাজার ব্লগে লিখেছেন, তাঁর পাশের বাড়ির রকে থাকা এক মেয়ের কথা। বদ্ধ উম্মাদ হিসেবে সমাজে বিবেচিত এই মেয়েটি কি আসলে পাগল? এই জিজ্ঞাসা তাঁর মনে। কেননা একরাতে তিনি আবিষ্কার করেন, ‘‘মেয়েটা হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে আর বলছে: ‘কতদিন কিছু খাইনি, পরার কাপড় নেই। উঃ, পারি না, কোথায় যাব আমি। আর পারি না। ’ জানালা দিয়ে দেখলুম মেয়েটা হাঁটুতে মুখ ঢেকে কোনো উপন্যাসের নায়িকার মতো রোদন করছে। একবার মুখ তুলল সে- তার বৃষ্টিধৌতমুখ দেখলুম, অশ্র“ময় চোখ দেখলুম- সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ’
সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীলের এই পোস্টগুলো পাওয়া যাবে মাইডট আননন্দবাজার ডটকম/ব্লগ ঠিকানায়। সুনীলদা ছিলেন দুই বাংলার সেতুপুরুষ। তিনি খুব আস্থার সঙ্গে বলতেন হিন্দি পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করে ফেলছে। বাংলাদেশই হবে বাংলা ভাষার রাজধানী।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই প্রস্থান বাংলা সাহিত্য তো বটেই, বাংলাদেশের জন্যও বড় শোকের। তিনি সময়ে অসময়ে আর আসবেন না বাংলার সুনীল প্রান্তরে। নাড়ীর সে টান ছিন্ন করে আজ তিনি জায়গা করে নিয়েছেন শোক-সন্তাপে,পত্রিকা টিভি-সবখানে। সব জায়গায় একই কথা ফিসফিসে শোকার্ত কণ্ঠ বলছে: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই! বাংলা, বাংলার আকাশ, বাংলার বর্ণমালায় তাই শোকের ছায়া।
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার jewel_mazhar@yahoo.com