ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

নান্টু মিয়ার কোরবানি আর দোনলা বন্দুক

মাজেদুল নয়ন; স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:১১, অক্টোবর ২৭, ২০১২
নান্টু মিয়ার কোরবানি আর দোনলা বন্দুক

রামগঞ্জ, লক্ষীপুর থেকে: কোরবানি নয়, বন্দুকে ব্যস্ত নান্টু। শহরের গলিতে নান্টু মিয়ার ঈদ ভাল কাটে না।

কোরবানি ঈদের নামাজ হয় অনেক সকালে। তবে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র নান্টুর সকালে উঠতে কষ্ট হয় না। মর্নিং শিফটের স্কুলে যেতে হলে সকাল ৬ টায় উঠতে হতো এমনিতেই।

সকালের ঠান্ডা পানিতে গোসল করে, পাঞ্জাবি পড়ে মসজিদে রওনা দেয় নান্টু।   রাস্তায় কয়েকজন মুরুব্বি প্রতিবেশীকে দেখতে পায়। যাদের সাধারণত এতো সকালে দেখা যায় না।   নান্টুর খুব ভালো লাগে। নান্টু দেখতে পায় নামাজের আগেই গরুকে গোসল করিয়ে পানি খাওয়ানো হচ্ছে। পানি খাওয়ালে কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানো সহজ হয়।

রমজানের ঈদ আর কোরবানির ঈদের পার্থক্য নান্টুর কাছে ধরা পড়ে সহজে। নান্টুর বাবা কোরবানি দেয় না। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য তিনি লাভ করতে পারেননি। নান্টুদের ঢাকায় রেখেই বাড়িতে যান বাবা।

রমজানের ঈদের সকালে নামাজ পড়েই স্কুলের বন্ধুদের বাসায় যাওয়া যেত। কিন্তুঈদে নামাজ শেষেই সবাই পশু কোরবানি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে না নান্টুর।

নামাজ পড়েই নান্টু বাসায় ফেরে। মায়ের মুরগি রান্না দেখে বলে,  ও আমাদের মুরগি কোরবানি হচ্ছে।

মায়ের জবাব, মুরগি কোরবানি হয় না, এসব বললে গুনাহ হয়। সোয়াব কামানোর পথ খুঁজে পায় না ৯ বছরের নান্টু।

সকাল ১০ টার মধ্যেই রাজধানীর বেশিরভাগ বাড়িতে কোরবানির মাংস চুলায় চড়ে। কিন্তু, বাড়িতে কোরবানির মাংস রান্না হচ্ছে না দেখে খুব মন খারাপ হয় নান্টুর। স্কুল খুললে বন্ধুদের কী বলবে-তার বাবা কি কোরবানি দিয়েছেন। এই ভেবে নান্টু খুব অস্থির হয়ে পড়ে। তাই এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে নান্টু। উদভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে নাখালপাড়া রেললাইনের দিকে। মনে পড়ে সেখানে ছোট ছোট দোকানে প্লাস্টিকের খেলনা বিক্রি হয়। দোনলা বন্দুকের খোঁজে বের হয় নান্টু।

বিকেলে বের হলেই নান্টুর দেখা হয় বন্ধুদের সঙ্গে। বাবার মতোই মিথ্যা বলতে শিখেছে  নান্টু। গ্রামে যেমন তার বাবা বলে বেড়াচ্ছেন শহরে কোরবানি দেয়া হচ্ছে। তেমনি নান্টুও বন্ধুদের বলে বেড়াচ্ছে, গ্রামের বাড়িতে কোরবানি দিতে গেছেন বাবা। বাবা একাই একটি গরু কোরবানি দিচ্ছেন। গরুর রং, শিং.....

কোরবানি দেয় নান্টু মিয়া:
নান্টু এখন ২৮ বছরের যুবক। ঈদগাহ, মসজিদ ও মাদ্রাসায় ঈমামের জন্যে আলাদা আলাদা দানবাক্সে দান করে  নান্টু। অবসরে যাওয়া বৃদ্ধ বাবা বেশ কয়েক বছর ধরেই কোরবানি দিচ্ছেন, সাহায্য করছে নান্টু। নামাজ শেষে বাড়ির লোকদের সঙ্গে ভাগে দেওয়া কোরবানির পশু জবাই করা হয়।

১৯ বছর আগের কোরবানির ঈদের সকালে বন্ধুদের পরিবার যেমন কোরবানি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, নান্টুও এখন ব্যস্ত। পশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো বা মাংস কাটা নিয়ে ব্যস্ত সে। এখন আর এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে হয় না নান্টু এবং তার বাবার।

৭ ভাগে মাংস ভাগ করা হলে। দুভাগ বুঝে নেয় নান্টুরা।

গ্রামের গরিব শিশুরা মাংসের জন্যে আসে। এদের অনেকেই প্রতিবেশী। খালি হাতে ফেরায় না নান্টুর বাবা। অনেক পরিবারই আছে, হয়তো বছরের এই একটি দিনই মন ভরে গরুর মাংস খেতে পারে।

বিকেলের আগেই বেড়াতে আসেন বয়সে বড় শামছু ভাই। কোরবানির কথা জিজ্ঞাসা না করলেও জবাব দেন, ঢাকাতেই কোরবানি দিয়েছি। সরকারি অফিসের কেরানি শামছু ভাইয়ের এক ছেলে, এক মেয়ে এবং স্ত্রী থাকেন ঢাকাতেই। বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে নাকি ঈদ করতে এসেছেন তিনি।

রুটি দিয়ে মাংস ছিড়ে খান  নি¤œ মধ্যবিত্ত শামছু। ঢাকায় গিয়ে কোরবানির  মাংস খেতে হবে তাড়াতাড়ি! সে কারণেই হয় তো এতো তৃপ্তি নিয়ে দ্রুত খান শামছু  ভাই। শিশু বয়সে বাবার বাড়িতে এসে ঈদ করার কথা মনে পড়ে নান্টু মিয়ার। শামছু ভাইয়ের ছেলেও হয়তো দোনলা বন্দুক কিনতে গেছে।

নান্টুর ছেলের কোরবানির ঈদ:
নান্টুর ছেলে, ৬ বছরের ফসল গত চারদিন ধরেই সারাদিন ছিল গরু নিয়ে। বছরে একবারই গরু নামক পশুটির সঙ্গে দেখা হয় তার। ফসল সব বাদ দিয়ে বসে থাকে গরুর সামনে। পাহারা দেয়, ঘাস খাওয়ায়। বশ মানলে গরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নান্টুর ছেলে।

নান্টুর স্ত্রী কয়েকদিন ধরেই ব্যস্ত ডিপ ফ্রিজ পরিস্কার আর মশলা বাটাতে। বুয়াকেও বেশি সময় ধরে রাখছেন, বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে। ঘর পরিস্কার করা, নতুন নতুন জিনিসপত্র কেনা, ব্যস্ত সময় কাটে নান্টুর স্ত্রীর।

সকালে কোরবানি হওয়া পশুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে নান্টু। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফসল। বিকাল পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে বাবা-ছেলে দুজনেই। ফসলের যেতে হয় না দোনলা বন্দুক কিনতে।

চোখ বুজে, ঢোক গিলে নান্টু মিয়া:
বাড়ির উঠানে বড় গরু কোরবানি দেওয়া হচ্ছে। ডায়াবেটিসের কারণে আর উঠতে পারেন না বাষট্টি বছরের নান্টু। বয়সের তুলনায় অসুস্থ বেশি হয়েছে। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়।

বছর খানেক হলো ডিপ ফ্রিজ পরিস্কার করা নান্টুর সহধর্মিনী বিদায় নিয়েছে। আর প্রবাসী  ফসলের খোঁজ নেই ৩ বছর। ঘরের জানলা দিয়ে উঠানে তাকালে লাল লাল গরুর মাংসের টুকরা দেখতে পান নান্টু। সিনার হাড্ডির দিকেও চোখ যায়।

দুপুরের মধ্যেই নাকে এসে লাগে গরুর মাংস রান্নার ঘ্রান। জিভে জল আসে নান্টুর। কেউ যদি বৃদ্ধকে দয়া করে না দেয়, এবার আর মাংস খাওয়া হবে না নান্টুর। চোখ বুজে, ঢোক গিলেন নান্টু মিয়া। চোখের সামনে ভাসে প্লাস্টিকের দোনলা বন্দুক।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা;  অক্টোবর ২৭,  ২০১২
এমএন/এআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।