আফগানিস্তানের নারীদের উপর বারবার তালেবান সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে। তারপরও সে দেশের মেয়েরা স্কুলে যাওয়া এখনও বন্ধ করেনি।
রাজিয়া জান জাবুলি এডুকেশন সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বলেন, যেদিন আমাদের স্কুলের প্রথম দিন সেদিন শহরের অন্য একটি স্কুলে গ্রেনেড হামলা হয়। সেখানে ১০০জন মেয়ে নিহত হয়। প্রতিদিনই তালেবানরা কোনো না কোনো মেয়ের গায়ে এডিস ছুড়ছে। অথবা পানিতে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলছে।
আফগানিস্তানের মেয়েরা যাতে কোনোভাবেই শিক্ষিত হতে না পারে; সে বিষয়ে তালেবানরা সবসময় সোচ্চার ছিল। তারা জানে, যদি আফগানিস্তানের মেয়েরা শিক্ষিত হয়, তাহলে তারা নিজের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠবে। তালেবানরা তখন আরও দূর্বল হয়ে পড়বে। এসব মাথায় রেখেই তারা হামলা চালায়। কিন্তু তালেবানদের সব ভয়কে উপেক্ষা করে হাজার হাজার আফগান মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। পড়াশোনা করছে।
এতো সব বাধাকে উপেক্ষা করেই রাজিয়া স্কুল চালিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের ছোট্ট এক গ্রামে তিনি নারীশিক্ষার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। ২০০৮ সালে ছোট্ট পরিসরে শুরু করেছিলেন জাবুলি এডুকেশন সেন্টার। বর্তমানে সে ছোট্ট পরিসর বড় হয়ে ১৪ কক্ষের পূর্ণ স্কুলে রূপ নিয়েছে। যেখানে ৩৫৪ জন মেয়ে বিনা পয়সায় পড়াশোনা করছে।

রাজিয়া খুব সহজেই কাজ করতে পারছেন তাও কিন্তু নয়। শুধু তালেবানদের হামলা নয়; তাকে যুদ্ধ করতে হয় স্থানীয় মানুষদের সঙ্গেও। অনেকেই তাকে নারীশিক্ষা বন্ধ করে পুরুষদের স্কুল শুরু করতে চাপ প্রয়োগ করেন।
রাজিয়া এ সম্পর্কে সিএনএনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাকে অনেকেই বলে, ছেলেরা হলো আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ। সুতরাং মেয়েদের শিক্ষার কোনো দরকার নেই। তখন তাদের বলি, মেয়েরা হলো এদেশের চোখ। তোমাদের মতো অন্ধদের চোখ হবে এই শিক্ষিত মেয়েরাই।
রাজিয়ার স্কুলে এখন পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। শুরু হওয়ার পর থেকে স্কুলটিকে দাঁড় করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন রাজিয়া। এমনকি স্কুলের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ নজর আছে তার। তিনি স্কুলের দেয়াল পাথর দিয়ে তৈরি করেছেন। এমনকি তার স্কুলের পানির সর্বরাহ ব্যবস্থার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখেন। কারণ, আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাওয়ার পানিতে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। সেজন্য রাজিয়ার স্কুলের সিকিউরিটি ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর।
প্রতিদিন সকালে নিয়োগকৃত সিকিউরিটিরা ক্লাসরুমের সবগুলো কক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখেন। রাজিয়া স্কুলে আসেন সবার আগে। তারপর নিজেই পানি খেয়ে দেখেন।
রাজিয়া জান ১৯৪০ সালে আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। রাশিয়া যখন আফগানিস্তানে হামলা চালায় তখন তার পরিবারের অধিকাংশ মানুষই নিহত হন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই থেকে যান। কিন্তু দেশে ফিরে আসার তাড়না জন্মায় ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর।
টুইন টাওয়ারের হামলা সম্পর্কে রাজিয়া বলেন, সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কান্না যারা দেখেনি তারা বুঝবে না সে দুঃখের কথা। এবং যুক্তরাষ্ট্রে আফগানিস্তানীদের উপর বাড়াবাড়ি রকমের নজরদারী ছিল প্রচন্ডরকমের মানসিক চাপ।
এরপর স্বামীর সঙ্গে ২০০২ সালে আফগানিস্তানে ঘুরতে আসেন রাজিয়া। এখানে নারীদের অধিকার ছিল চরমভাবে বিপর্যস্ত। তখনই তিনি ভাবলেন দেশের জন্য কিছু করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ফিরে গিয়েই তিনি অর্থ সংগ্রহ শুরু করলেন। সবাইকে গিয়ে আফগানিস্তানে নারীদের স্কুলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কিছু টাকা সংগ্রহ করে তিনি ২০০৪ সালে আবার দেশে ফিরলেন। স্কুল নির্মাণের জন্য জমি দেখতে আফগানিস্তান আসেন। সুবিধামত জায়গাও পেয়ে যান।
জায়গাটি কিনে তিনি পুরো দমে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থসংগ্রহ শুরু করে দেন। এরপর ২০০৫ সালে আফগানিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। শিক্ষামন্ত্রনালয় স্কুলের জমি-জমা সংক্রান্ত কাগজপত্রের সব সমস্যাগুলো দেখার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। মন্ত্রনালয় থেকে রাজিয়াকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হয়। এরপর একটি এনজিও শুরু করেন। যার নাম দেওয়া হয় ‘রাজিয়া রে অব হোপ’। এনজিও’র মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে সুবিধা হয়। এ জন্য শুরুতেই এনজিও শুরু করে ২০০৮ সালেই দাঁড় করিয়ে ফেলেন জাবুলি এডুকেশন সেন্টার।
রাজিয়া এবছর ‘সিএনএন হিরোস অব ২০১২’ হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। সিএনএন শুধু একটি স্কুল নির্মাণের জন্য তাকে মনোনয়ন দেয়নি। সিএনএন সূত্র জানিয়েছে, রাজিয়া জান শুধু স্কুল নির্মাণ করেনি। তিনি একই সঙ্গে তার স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেন। অশিক্ষিত সমাজকে বোঝান শিক্ষার উপকারিতা। একটি অন্ধকার গ্রামকে আলোকিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাওয়া রাজিয়াকে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম সিএনএন হিরো হিসেবেই মনে করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক