ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

এপারে কলকাতা ওপারে হাওড়া

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৪৭, নভেম্বর ৮, ২০১২
এপারে কলকাতা ওপারে হাওড়া

কেউ বলেন হুগলি নদী। গঙ্গা কিংবা ভাগীরথীও বলা হয় এই নদীকে।

এর ওপারেই হাওড়া জেলা। আর এপারে কলকাতা। হুগলি নদীর উপর সেই ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল হাওড়া ব্রিজ। রবীন্দ্র সেতু নাম দেয়া হলেও কাউকে বলতে শুনিনি।

হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতু দেখে মনে মনে ভাবলাম, আমাদের ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরা। এই জিঞ্জিরাও হতে পারে জেলা, আর বুড়িগঙ্গা ব্রিজের নাম নজরুল সেতু হলে তো ভালই হতো। হাওড়া জেলার পূর্বে হুগলি, দক্ষিণে হুগলি নদী, নারায়ণ নদী আর মেদিনীপুর জেলা।

২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী হাওড়া জেলায় লোকসংখ্যা ৪৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৩৮ জন। আয়তন ১৪৬৭ কি.মি.। মহকুমা ২টি হাওড়া ও উলুবেড়িয়া। এ জেলার গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন-বেলুড়, কোলাঘাট, হাওড়া স্টেশন (পুরাতন), হাওড়া স্টেশন (নতুন)।

পুলিশ স্টেশন আমতা, বেলি, বাগনান, দাসনগর, দমজুর, হাওড়া, শিবপুর, শ্যামপুর, বেতলি, রানিহাতি, উলুবেড়িয়া।

হাওড়াকে কেউবা বলেন নদীর দেশ। বয়ে গেছে হুগলি, সরস্বতী, রূপনারায়ণ, দামোদর। দামোদরের দুই উপনদী রয়েছে এই হাওড়া জেলায়। একটির নাম কানা দামোদর, অপরটি পুরানো দামোদর।

হাওড়ায় তো অনেকবারই গেছি দিল্লি, অমৃতসর, মুম্বাই, চেন্নাই যাবার জন্য হাওড়া স্টেশনে আসা। একবার ভাবলাম হাওড়া হয়ে কত না জায়গায় যাচ্ছি এবার হাওড়ায় দু-চার দিন থেকে দেখি না এই জেলাকে। হাওড়া ও কলকাতাকে আমার কাছে জোড়া শহর বলেই মনে হয়েছে।

হাওড়া কিন্তু পশ্চিম বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ব্যবসায়িক শহরও বলা হয়। অসংখ্য শিল্প কলকারখানা রয়েছে হাওড়ায়। এখানে আছে পাটকল, কেমিকেল ফ্যাক্টরি, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বোটানিকাল গার্ডেন, বেলুড় মঠ, রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি। বিদ্যাসাগর সেতু, হাওড়া ব্রিজ, রেলস্টেশন, বেলুড় মঠ- এখানের অন্যতম আকর্ষণ।
হাওড়াকে ভালভাবে দেখা ও জানার জন্য উঠলাম হাওড়ার সীতা হোটেলে। এবার চললাম, বেলুড় মঠ দেখতে। দক্ষিণেশ্বর থেকে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে জিটি রোডে গড়ে উঠেছে বেলুড় মঠ । কলকাতা থেকে দূরত্ব ১০ কি.মি. আর হাওড়া থেকে ৬ কি.মি.র মতো। বাস ও মিনিবাস যাচ্ছে কলকাতার এক্সপ্লানেড থেকে হাওড়ায়।

তবে দক্ষিণেশ্বর থেকে নৌকায় বেলুড় যাওয়াই সুবিধার। নৌকা থেকে ১৯২৭ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তৈরি বিবেকানন্দ সেতুটির সৌন্দর্যও দেখা যায়। বাসও যাচ্ছে ৫১ ও ৫৬ রুটের দক্ষিণেশ্বর হয়ে বেলুড়ে। ১৮৮৬ সালে প্রয়াত ঠাকুরের পূত অস্থি ৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ সালে স্বামী বিবেকানন্দ কাঁধে বয়ে এনে প্রতিষ্ঠা করেন বেলুড়ে।

আর ১৯৩৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে স্বামী বিবেকানন্দ পরিকল্পিত এই মঠ রূপ পায় পুণ্যভূমে। এখানে মঠের স্থাপত্যে ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন রয়েছে। চার্চ, মসজিদ, আর মন্দিরÑ এই তিনের সমন্বয়ে রূপ পেয়েছে বেলুড় মঠ।

মঠটি পরিচালনা করেন ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন। মিশনের মূল দপ্তরও এই মঠে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৯০২ সালের ৪ জুলাই দেহ রাখেন বিবেকানন্দ, সমাধিও হয়েছে মঠ প্রাঙ্গণে। মঠের উত্তর-পূর্বে গঙ্গার তীরে দ্বিতল বাড়িÑ স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন ওখানে। স্মারকরূপে স্বামী বিবেকানন্দের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের প্রদর্শনী বসেছে। স্বামী বিবেকানন্দের এ বাড়িতে ঢুকে ফিরে গেলাম আরেক জগতে। তন্ময় হয়ে দেখেই যাচ্ছি।  

বেলুড় মঠের এক ঠাকুরের সঙ্গে যেচে আলাপ করলাম। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বিখ্যাত ব্যক্তিরা এখানে কে কে আসেন? দেখুন আমার বয়স আজ নব্বই। ফিল্ম স্টারদের মধ্যে অনেকেই তো আসতেন। এখন আর আসেন না। তবে কানন দেবীর কথা খুব করে মনে পড়ে। তিনি নায়িকা চরিত্র থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন সেই ১৯৫৫-৫৬ সালের কথা।

উনি প্রতি মাসে একবার করে এই মঠে আসতেন। শুনেছি, হাওড়ার কোন এক গ্রামে তার জন্মস্থান। বেলুড় মঠে কানন দেবী আসলেই দেখতাম তাকে ঘিরে অসংখ্য মানুষের ভিড়।

ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলাম, কানন দেবী কী আপনার সঙ্গে কখনও কথা বলেছিলেন? ঠাকুর একটু হেসে বললেন- বারে উঁনি এখানে এসে প্রথমেই আমাকে খুঁজতেন। সঙ্গে থাকতেন তাঁর স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য।

তারপর কত বছর চলে গেছে, উনি বৃদ্ধা হলেনÑ চিরতরে বিদায় নিলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। দেখুন, মানুষের জীবনটা কী! এ পৃথিবী মিথ্যে ছাড়া কিছুই নয়।
‘কানন দেবী অভিনীত কোনো ছবি কী দেখেছিলেন?’ ঠাকুর একটু হেসে- ‘মুক্তি’র কথা খুব করে মনে পড়ে ...।

এই বলে ঠাকুর গুণ গুণ করে গেয়ে উঠলেন ... ‘তার বিদায় বেলার মালাখানি আমার গলেরে/ দোলে দোলে বুকের কাছে পলে পলে রে/ গন্ধ তাহার ক্ষণে ক্ষণে জাগে ফাগুন সমীরণে/ গুঞ্জরিত কুঞ্জ তলে রে/ দিনের শেষে যেতে যেতে পথের পরে/ ছায়াখানি মিলিয়ে দিল বনান্তরে। সেই ছায়া এই আমার মনে, সেই ছায়া ওই কাঁপে বলে/ কাঁপে সুনীল দিগঞ্চলে রে ...। ’

এদিকে দেখি ঠাকুরের দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কেঁদে কেঁদে বললেন, বিভিন্ন সময়ে কানন দেবীর কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পেতাম। যেদিন উনি মারা গেলেন সেই রাতে ঘুমই হলো না ....।

গঙ্গার পাড়ে এসে বসলাম। দু’নয়ন ভরে দেখে যাচ্ছি গঙ্গাকে। এবার নৌকায় উঠে গঙ্গাকে দেখলাম দু’নয়ন ভরে। মাঝি বললো, এই গঙ্গার পাড়েই ব্রহ্মানন্দ মন্দির, মাতৃমন্দির, স্বামীজির মন্দির ও রামকৃষ্ণ শিষ্যদের সমাধি পীঠ।

শ্রীরামকৃষ্ণ মিউজিয়াম দেখে তো আরও অবাক হলাম। দেখলাম, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়াও নানা শিষ্যের স্মৃতিপুত্র সম্ভারের সঙ্গে তদানীন্তন পরিবেশ নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। এদিকে সারদা মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ রামকৃষ্ণ দর্শন অর্থাৎ ছবি ও পুতুলে ঠাকুরের কথামৃত রূপ পেয়েছে। ওখানে গিয়ে আরও জানলাম, সকাল ৬ টা ৩০ থেকে ১০টা ৩০ আর বিকেল ৩টা ৩০ থেকে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ পর্যন্ত খোলা তাকে বেলুড় মঠ।

হাওড়া জেলায় রয়েছে সুন্দর সুন্দর জায়গাÑ এই যেমন বালিপুর, হাবলী, উদয় নারায়ণপুর, দেবীপুর, সাহানগর, রাসপুর, খালনা, মানকুর, পানি ত্রাস, বাগনান, কুলগাছিয়া, ময়নাপুর, শ্যামপুর, শীতলপুর, শিবগঞ্জ, গুজারপুর, গোবিন্দপুর, কমলপুর, হীরাপুর, উলুঘাটা, পাঁচলা, জয়নগর, দেউলপুর, ডোমজুড়, রামকৃষ্ণবাটি, দুর্গাপুর, জগদীশপুর, বেলুড়, গাদিয়ারা, সাতঘরা, পাশমূল- কত কি সব।

হাওড়া ঝুলন্ত সেতু, বিদ্যাসাগর সেতু পড়েছে এই হাওড়া জেলায়। কলকাতার পূর্বে আর হাওড়ার পশ্চিমে প্রবাহিত হুগলি (গঙ্গা) নদীর ওপর ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩-এ শেষ হয় এর নির্মাণ কাজ। ২১৫০ ফুট দীর্ঘ, ৭১ ফুট প্রস্থ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্যান্টিলিভার সেতুর উচ্চতা ১৯৬ ফুট। ২৬ হাজার ৫০০ টন ইস্পাতে গড়া। থাম নেই একটিও। ৮ সারি গাড়ি চলতে পারে একত্রে পাশাপাশি। এছাড়া রয়েছে পায়ে চলার পথ দু’পাশে।

১৯৪৩ সাল থেকে গাড়িও চলছে সেতু দিয়ে। তার আগে ১৮৭৪ থেকে নৌকা সাজিয়ে পাটাতন (পল্টুন ব্রিজ) গড়ে গাড়ি পার হতো গঙ্গা। এটি আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর উপহার। এই ঝুলন্ত সেতুর চাপ লাঘব করতে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে ২ কিমি দক্ষিণে ১০ অক্টোবর ১৯৯২ সালে তৈরি হয়েছে এশিয়ার দীর্ঘতম, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কেবল স্টেড ব্রিজ অর্থাৎ দ্বিতীয় হুগলি সেতু গঙ্গায়।

এই সেতুটি স্তম্ভে ১২১টি তারের রশিতে ঝুলন্ত। ভিত এর ১০০ ফুট গভীরে। ৩৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এক উজ্জ্বল প্রতীক দ্বিতীয় হুগলি সেতু বা বিদ্যাসাগর সেতু।

হাওড়া থেকে ট্রেনে উলুবেড়িয়া নেমে এরপর পরদিন বাস ধরে বিকেলে এসে পৌঁছলাম গাদিয়ারায়। ওখানে হুগলি নদীর তীরে এক হোটেলে এসে উঠলাম। সন্ধ্যার পর বসে আছি হুগলি নদীর এক প্রান্তে। দেখছি, পালতোলা নৌকা চলে যাচ্ছে দূর অজানার দেশে।

এক অচেনা লোক পালতোলা নৌকা দেখে গাইতে শুরু করলো : ‘আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি/ তুমি এ ঘাটে লাগায়ারে নাও/ লিগুম কথা কইয়া যাও শুনি/ তোমার ভাইটাল সুরের সঙ্গে সঙ্গে কান্দে গাঙের পানি/ ও তার ঢেউ লাগিয়া যায় ভাসিয়া কাঙ্খের কলসখানি। পূবালি বাতাসে তোমার নায়ের বাদাম ওড়ে/ আমার শাড়ির অঞ্চল ধৈর্য না ধরে/ তোমার নি পরানরে মাঝি হরিয়াছে কেউ/ কলসী ভাসায়া জলে গুনেছনি ঢেউ ...। ’

গানখানি তার কণ্ঠে শুনে মনে পড়লো লোকগীতির সম্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমেদের কথা। ঐ লোকটিকে বললাম ,এতো আব্বাস উদ্দিন আহমেদের গান ...। তখন তার মুখে হাসি দেখে কেমন জানি একটু উত্তেজিত হলাম। তিনি জানালেন, দেখুন ওই আব্বাসউদ্দিন আহমেদ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার বলরামপুরের বাসিন্দা ছিলেন।

চুপ করে রইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম? হেসে..... সৌমিক রায় । হাতে হাত রেখে বললেন, বোটানিকাল গার্ডেন দেখবেন, চলুন।

হাওড়া রেল স্টেশন থেকে ৪ কিমিঃ দক্ষিণে হাওড়া জেলার শিবপুরে হুগলী নদীর পশ্চিম তীরে রূপ পেয়েছে বোটানিকাল গার্ডেন। ২৭২ একর ব্যাপ্ত গার্ডেনে ৩৫ হাজার  ফুল ও ফল ছাড়াও ১৫ হাজার নানান গাছ রয়েছে।

এখানের মূল আকর্ষণ ২৭০ বছরের প্রাচীন বটবৃক্ষ। সৌমিক রায় আর আমি এসে বসলাম বটবৃক্ষের তলে। উপরে তাকিয়ে দেখি কত না প্রজাতির পাখি।

বোটানিকাল গার্ডেনে এসে শুনলাম, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থাকে এই গার্ডেন। সৌমিক রায় বললেন, ওই যে দূরে দেখছেন ঘাট ওখান থেকে ফেরিতে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতায় যাওয়া যায় ...।

বাংলাদেশ সময় : ১৩১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১২
সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর
Kumar.sarkerbd@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।