ঢাকা: ২০ জুন, ২০১২। সকাল ৯টায় পাবনার ব্র্যাক লার্নিং সেন্টার (বিএলসি) থেকে মোটর সাইকেলে রওনা দিলাম।
পাবনা থেকে ঈশ্বরদীর বড় রাস্তা ধরে মোটর সাইকেল একসময় চলতে শুরু করলো ডানের এক কাঁচা রাস্তা দিয়ে। দুই-তিন কিলো চলার পর থামলাম এক জায়গায়। মোটর সাইকেল রেখে দুই-তিনটি কাঁচা বাড়ি পেরিয়ে দাঁড়ালাম একটি টিনের ঘরের দরজায়। ঘণ্টাখানেক পর যখন সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে মটর সাইকেলে উঠলাম, তখন মনটা কেমন যেন স্মৃতিভারে কাতর লাগছিলো। ভার কাটতে কাটতেই পৌঁছালাম আরেকটি ব্র্যাক প্রাইমারি স্কুলে। একটি মাত্র শ্রেণী সেখানে। এক কক্ষে শ্রেণীর বিদ্যালয়ে বছর পার করবে আর নতুন ক্লাসে উঠতে উঠতে ক্লাস ফাইভ শেষ করে চলে যাবে। সে স্কুল দেখা শেষ করে যখন মটর সাইকেলে নতুন প্রোগ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটছি, তখন মনে মনে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সেই শৈশবের দিনগুলোতে। ভাবছিলাম, এমন স্কুলও করা সম্ভব!
৩ জুন ব্র্যাকের লার্নিং ডিভিশনে (বিএলডি) যোগ দিয়েছি সিনিয়র সম্পাদক হিসেবে। আমার তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং বাকি সহকর্মীদের আন্তরিকতার ছোঁয়া পেতে না পেতেই নির্দেশ হলো মাসের দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে যথাক্রমে উত্তরা, পাবনা এবং ময়মনসিংহে থাকতে হবে। উদ্দেশ্য, বিএলডি এবং ব্র্যাকের কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। উত্তরা থাকতে বিএলডির নিজস্ব কার্যক্রমের বাইরে বিশেষ কিছু দেখা হয় নি। পাবনাতে গিয়ে সে দেখা শেষই হতে চায় না! প্রতিদিন দুই-তিনটি প্রোগ্রাম দেখছি আর বিস্ময়ের ভার বাড়ছে। সে বিস্ময় বিমূঢ়তায় পরিণত হলো যখন শিশু শ্রেণীর ঐ শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলাম।
মাঝারি আকৃতির একটি সাধারণ ঘর। চারটি ছোট ছোট দলে বৃত্তাকার আকারে বসে আছে শিশুরা। যে দিকটায় দরজা সে পাশে ব্ল্যকবোর্ড, আর কাছেই শিক্ষিকা সালওয়ার-কামিজ পরিহিত এক তরুণী। রফিক ভাই এবং শাহ আলম ভাইকে নিয়ে ঢুকলাম সে ঘরে। যারা ব্র্যাকের চর্চার সাথে পরিচিত নন, তাদের জন্য বলে রাখা দরকার যে ঊর্ধ্বতন, অধস্তন সকল কর্মীকেই এখানে ভাই বা দাদা সম্বোধন করা হয়। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই ডান পাশের দলটির একটি ছেলে নিজের দলের পরিচয় দিলো এবং তার ডান পাশের দলকে আহবান করলো তাদের দলের পরিচয় দিতে। পর্যায়ক্রমে চারটি দল তাদের নিজেদের পরিচয় দিল। খেয়াল করলাম, তাদের পরিচয় দানের মধ্যে শিক্ষার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু চার-পাঁচ বছরের শিশুগুলো আমাদের মতো অপরিচিত মানুষদের সাথে স্বচ্ছন্দ্যে কথাবার্তা বলছে, স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করছে, এসব দেখে যেন বিস্ময় কাটতেই চাচ্ছিলো না! বারবার মনে হচ্ছিলো, সারা পাবনা সদর উপজেলার ২৯টি বিপিপিএসের মোটামুটি ৮৭০ জন শিশুই কি এমন দক্ষ হয়ে উঠেছে! তাহলে এমন স্কুলগুলোতে পড়া সারা দেশের ১৫ হাজার ১৬৪টি বিপিপিএস স্কুলের মোটামুটি প্রায় চার লাখ শিশুকে কি আমরা এমন উচ্চতায় নিয়ে আসতে পারলাম?
মাটিতে ম্যাট পাতা। বিশেষ নকশা আছে ম্যাটে। একেকটি দল ম্যাটের চার কোণার চারটি গোল বৃত্তকে কেন্দ্র করে বসে। বৃত্তগুলোর ওপর সাজানো তাদের বই, স্লেট, স্কেল, মাঝের ছোট বৃত্তে গোল করে সাজানো কলম রাখার পটগুলো। টিনের বেড়াতে ঝোলানো আছে শিক্ষা উপকরণ। ঘরসজ্জার এসব উপকরণ খেয়াল করতে করতেই হঠাৎ দেখলাম শিক্ষিকা বোর্ডে আগে থেকে আঁকা চারটি প্রতীকের একটির ওপর হাত রাখলেন এবং শিক্ষার্থীরা মুহূর্তেই ইংরেজি ‘ইউ’ বর্ণের আকৃতিতে বসে পড়লো।
গ্রামের সাধারণ দরিদ্র মানুষের সন্তানদের এই ক্ষিপ্রতা দেখে মুগ্ধ হলাম। শিক্ষিকা বললেন যে ঢাকা অফিস থেকে একজন অতিথি এসেছেন, যাকে আমরা আমাদের পরিচয় দিব। ঘোষণা হতেই ডান পাশে বসা শিশুটি তার পরিচয় শুরু করলো। ‘আমার নাম.... তোমার নাম কি?’ বলে সে তার ডানের জনকে ইঙ্গিত করলো। অদ্ভুত এক খেলা খেলা ভাব। নিজেকে প্রকাশ করতে পারার অদ্ভুত এক কায়দায় দক্ষ তারা। পরিচয় পর্ব ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আমার কাছে আসে। নাম বলার পর শিক্ষিকা সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন অতিথির কাছে কারো কোন বিষয় জানার আছে কি না। তক্ষুণি হাত তুলে অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন আসতে থাকে আমার দিকে- ‘কোথায় থাকেন’, ‘কজন ছেলেমেয়ে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরপর ‘ট্রেন ট্রেন’ খেলা শুরু হতেই মনে হচ্ছিলো, শিক্ষাদানের এমন একটি আনন্দময় পরিবেশের কথাই কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেবেছিলেন? শিশুর মননকে লালনের এমন ভাবনা ব্র্যাক পেলো কোথায়! কোন উদ্দীপনা ব্র্যাকের নীতিনির্ধারকদের এমন একটি পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রণোদনা যোগালো?
আমি যখন বিস্ময়ের ঘোর পার করছি, তখন শুরু হয়ে গেছে ‘ট্রেন’। হাতে লাল আর সবুজ পতাকা নিয়ে প্রস্তুত শিক্ষিকা। বাঁশি বাজতেই চলতে শুরু করলো ‘ট্রেন’। খানিক পর বাঁশির সাথে লাল পতাকা উঁচু হলো। শিক্ষিকা মুখে উচ্চার করলেন, ‘নখপুর স্টেশন’। সকল শিক্ষার্থী তাদের দুই হাত প্রসারিত করে নখ দেখানোর ব্যবস্থা করলো। শিক্ষিকা প্রত্যেকের নখ পরীক্ষা করলেন, পরিষ্কার আছে কিনা এবং কাটা হয়েছে কিনা। যতো সময় যেতে লাগলো, আমার অভিভূত হওয়ার পালা বাড়তে লাগলো। এরপর ট্রেন দাঁতপুর স্টেশন, চুলপুর স্টেশন, পোশাকপুর স্টেশনে থামলো।
আমাদের সময়ের স্বল্পতা ছিলো। ব্র্যাকের অন্য স্কুল প্রোগ্রামগুলো দেখতে যেতে হবে। সে কথা জানালাম শিক্ষিকাকে। তিনি ক্লাসকে জানালেন যে অতিথির সময় কম, তাই খেলা বাদ দিয়ে একটি দেশপ্রেমমূলক গান গাইতে। সবাই সমস্বরে নাচের তালে তালে সুর করে গাইলো একটি দেশপ্রেমের গান। শিক্ষিকা নিজেও নৃত্যে অংশ নিলেন।
ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। শিক্ষিকার সাথে কথা বললাম খানিক্ষণ। জানলাম, তার নাম রিমা খাতুন। দরিদ্র বাবা-মা পাঁচ সন্তানের একজন রিমা। এগারো বছর ধরে স্কুলটিতে শিক্ষকতা করছেন। ‘কেমন লাগে ব্র্যাক স্কুলে পড়াতে,’ প্রশ্নের উত্তর সাধারণ বাঙালী নারী রিমার মুখে দারুণ উজ্জ্বলতা ফুটে উঠলো। বারবার প্রশ্নে জেগেছে, এত সামান্য পারিশ্রমিকে এতোটা সন্তুষ্ট রয়েছেন কীভাবে রিমা। এসএসসি পাস রিমা বললেন, তার খুব গর্ব তিনি ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষক। বাচ্চাদের অভিভাবকেরাও তাকে একই রকম সম্মান দিয়ে থাকেন।
স্কুলে যাওয়ার এবং ফেরার পথে রফিক ভাই এবং শাহ আলম ভাইকে অনেক প্রশ্ন করেছি। কীভাবে স্কুল ঘরটি হলো, স্কুল পরিচালনা কমিটি কীভাবে গঠিত হয় ইত্যাদি সব প্রশ্নের উত্তরে বুঝেছি যে ব্র্যাক তাদের স্কুল চালাতে এমন একটি কৌশল অবলম্বন করেছে, যাতে করে নিকটবর্তী বাড়ির মানুষজন স্কুলটিকে তাদের সম্পত্তি মনে করেন, সমাজের সকল মানুষ স্কুলের পরিচালনায় অংশীদার হন। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার উদ্যোগটি যে মানুষের মনে বিপুল উদ্দীপনা জাগিয়েছিলো তা তো সকলেরই জানা। আর সে সম্পৃক্ততার ফলেই ক্রমে ক্রমে শিক্ষাঙ্গনটি এলাকার মানুষের সম্পত্তি হয়ে যায়। তারা এর ভালোমন্দের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন আত্মিকভাবে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে মোটর সাইকেল গিয়ে পৌঁছাল মজিদপুর গ্রামে। ঢুকে গেলাম একদম কাছাকাছি লাগানো ঘরের একটি পাড়াতে। একটি ঘরের বাইরে কমবেশি দেড় ফুট বাই দুই ফুটের একটি সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম এটাই স্কুল। টিনের ঘরের দরজার বাইরে উঠানে অনেকগুলো স্যান্ডেল সুন্দর করে বৃত্তাকারে সাজানো। আস্তে করে ঢুকলাম সেই ঘরে।
আয়তাকার সে ঘরেও ম্যাট পাতা। চারপাশ জুড়ে আসন। সবার সামনে সাজানো শিক্ষা উপকরণ। যতোক্ষণ থেকেছি, সব কিছুতেই মুগ্ধ হয়েছি। ঘরসজ্জা, শিক্ষার পরিবেশ সবকিছু মিলে এক প্রীতিময় পরিবেশ। বিলাসিতার প্রশ্নই নেই, কিন্তু প্রয়োজন মিটেছে পুরোটাই। শিশুরা সেখানে তার বয়স ও শ্রেণী উপযোগী পাঠ্যবিষয়ে যেমন জ্ঞানার্জন করেছে, তেমনি দক্ষতা অর্জন করছে নিজেদের উপস্থাপন করার ব্যাপারে। তারা নতুন মানুষের সামনে কথা বলছে, দল বেঁধে নির্দেশিতভাবে গান-নাচ করছে, শিখছে দৈনন্দিন পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোও।
সহযাত্রী দুই ম্যানেজার ভাইকে প্রশ্ন করে জানলামম এমন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার রহস্য।
স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীরা প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলটি তৈরির আগে ব্র্যাকের শিক্ষা বিভাগের উপজেলা অফিস থেকে সার্ভে করা হয়, কোথায় স্কুল দরকার। নিকট অঞ্চলে সরকারি প্রাইমারি স্কুল না থাকার কারণেই প্রয়োজনটি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। শিশুরা ঐ স্কুলে একের পর এক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে হতে ক্লাস ফাইভ পাস করার পর হয়তো ঐ স্কুলের কাজ শেষ হয়ে যায়। হয়তো ইতোমধ্যে কাছাকাছি অন্য কোনো জায়গায় নতুন একটি স্কুল চালু হয়ে যায়, যেটি নতুন বয়সের শিশুদের নিয়ে নতুন একটি স্কুল। কথা বললাম শিক্ষিকা জাকিয়াতুল আপার সঙ্গে।
পর্যায়ক্রমে জানলাম, সারা দেশে ব্র্যাকের ২২ হাজার ৬১৮টি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। হিসেব করলে দেখা যাবে, সে স্কুলগুলোয় মোট সাড়ে ছয় লাখের বেশি শিশু পড়াশোনা করছে।
সব মিলিয়ে দেখা যায়, ব্র্যাকের বিপিএস এবং বিপিপিএস নামের দুই ধরনের স্কুলেই মোট শিক্ষার্থী এগারো লাখ। সংখ্যার বিপুলতাতেও কিন্তু বিমূঢ় হতে পারেন যে কেউ। কিন্তু মোহিত হতে হয় ব্র্যাক স্কুলে শিশুদের শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি দেখলেও।
ব্র্যাকে কর্মী হিসেবে যুক্ত হয়েছি বলেই এমন ভাবনা, তা নয়। ব্র্যাকের স্কুল দেখতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, সেই তরুণ কাল থেকে আমি নিজেও তো স্বপ্ন দেখেছি বাংলাদেশের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের কাছে তাদের অধিকারগুলোর নিশ্চিত করবো, দরিদ্র পল্লীর শিশুদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করবো। আজ নিজের চোখেই দেখলাম, ব্র্যাকের উদ্যোগে ব্যাপক পরিসরে সে কাজটি বিপুল উদ্যমে এগিয়ে চলছে। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, ব্র্যাকের শিক্ষা কার্যক্রমকে কি টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত প্রসারিত করা যায় না? তাহলে তো ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ স্বাক্ষরতার (আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১) এ দেশে ৪৫ শতাংশের বেশি নিরক্ষরতায় অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হয় না!
লেখক: সিনিয়র এডিটর, ব্র্যাক লার্নিং ডিভিশন, ঢাকা
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১২
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর