ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘ওয়ারিশ-বেওয়ারিশ’

আহ্‌সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:১২, নভেম্বর ১১, ২০১২
‘ওয়ারিশ-বেওয়ারিশ’

রাস্তার পাশে ফেলা আবর্জনার স্তুপে নিজের আহার খুঁজছে কুকুর। কুকুরটি বেওয়ারশি নয়, কারণ তার গলায় একটি বেল্ট দেখা যাচ্ছে, যা ইঙ্গিত করে আমাদের মধ্য থেকে কেউ না কেউ এর মালিক।

তার সামনে বসে আবর্জনা থেকে বাতিল কাগজ আর ভাঙ্গারি জিনিসপত্র বেছে নিজের বস্তায় ভরছেন একজন ছিন্নমূল। তারও উদ্দেশ্য প্রায় একই, এগুলো বিক্রি করে নিজের এবং পরিবারের আহারের ব্যবস্থা করা।

dhakaরমনা পার্কে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের সামনের রাস্তার দৃশ্য এটি। রোববার দুপুরে এ পথে চলাচলকারীদের কেউ কেউ এ দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়েছেন। নাগরিক ব্যস্ততার কঠিন নিগড়ে নিত্য চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়া পথচারী আর গাড়ির আরোহী বাদ-বাকিরা পাশ কাটিয়ে বা নজর বাঁচিয়ে গেছেন অসহ্য এ দৃশ্যকে।

ভোজনরত কুকুর আর কাগজ কুড়ানো লোকটির একটু দূরে মাটিতে বসা শিশুটি বয়ষ্ক লোকটির মত চিন্তা-চেতনায় চালিত নয়। সে বরং কুকুরটির মতই নগদে নগদে তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করার জন্য মানুষেরই ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে নিচ্ছে পরম তৃপ্তিতে। উপযুক্ত ভাগ পাওয়ার আশায় তাকে ঘিরে ধরেছে এই নগরীতে সিটি কর্পোরেশনের চেয়ে দায়িত্ব সচেতন হিসেবে পরিচিত প্রকৃতির ঝাড়ুদার রূপী কিছু কাক। উন্মুক্ত ওই ডাস্টবিনের আবর্জনায় কত হাজার-কোটি রোগ জীবাণু গিজগিজ করছে সে ব্যাপারে শিশুটির কোনো হুঁশ-হদিশ নেই, থাকার কথাও না। এতই মজা করে শিশুটি সে খাবার খাচ্ছে যে একটি ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে তার দাঁতে মাংসও আটকে গেছে এবং তা সে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।

আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি, শিশুটির গলায় কোনো বেল্ট বা বন্ধনী নেই। কারণ, মানুষের ‘ওয়ারিশ-বেওয়ারিশ’ পরিচয়ের জন্য সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা অন্তত হাল আমলে প্রচলিত নেই। শিশুটির নিশ্চয়ই একটি নাম আছে। আমরা সেই নামটিও জানি না। তবে নগর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধাকা এ ধরনের হাজার হাজার শিশুকে এদের সামাজিক বা গোত্রগত নামে আমরা চিনি— টোকাই। দেশের গুণী কার্টুনিস্ট রণবী’র আদর করে দেওয়া এ নামকে ছাপিয়ে আরও একটি নামে এদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে একসময়। এ নামে ট্রাস্টও হয়েছে। মুখভরা সে নামটি হচ্ছে ‘পথকলি’।

তবে পথকলি ট্রাস্ট যিনি করেছিলেন এবং তার আগে পরে যারা বাংলাদেশ নামের এই ভূ-খণ্ডে যুগে যুগে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়েছেন, তারা কি আসলেও মনে-প্রাণে কিছু করেছেন তাদের জন্য? কিংবা অন্যসব ‘জন-দরদী সমাজ সেবকরা’?

dhakaএই ছবিগুলোতে অন্য অনেক গুরুতর প্রসঙ্গ ছাড়াও আরও কিছু বিষয় হয়তো নজর এড়িয়ে যাচ্ছে আপনার। বড় বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আলোচনা বা পদক্ষেপে হয়তো আমরা অজ্ঞাত কারণে নিষ্পৃহ; তাই আসুন, ছোট বিষয়গুলোতে একটু নজর দেই।

এক. এভাবে উন্মুক্ত স্থানে যখন তখন আবর্জনা ফেলা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব কি না? এ ধরনের অনুমতি দিয়ে সন্মানিত নগরবাসীদের কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে কি না?

দুই. সিটি কর্পোরেশন বা পরিবেশ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরে এসব ‘দৃষ্টিনন্দন’ দৃশ্য কোনো আবেদন সৃষ্টি করে কি না? এসব দেখার জন্য নিয়োজিত সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য অপসারণ বিভাগের কর্মীরা বেতন-টেতন পান কি না?

তিন. এ ধরনের দৃশ্য পথ দিয়ে যাওয়া বিদেশিদের নজরে পড়লে তা আমাদের জন্য কতটা শোভন হতে পারে?

চার. যুদ্ধজয়ী একটি জাতি হিসেবে এতটা বে-এক্তিয়ার বে-ওয়ারিশ কি আসলেও আমরা?

আসুন, শিশুটির ভূত-ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে না চাইলেও অন্তত ওপরের ছোট প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি একটু-আধটু!

দৃশ্যগুলো ক্যামেরাবন্দি করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট মোশাররফ হোসেন

বাংলাদেশ সময়: ১৮০১ ঘণ্টা, ১১ নভেম্বর, ২০১২
একে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।