ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

তেরশ্রী গণহত্যা

মুক্তিযুদ্ধ: শোকেপূর্ণ গৌরব ও অহংকারের ইতিহাস

শামীম হোসেন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:১২, নভেম্বর ২১, ২০১২
মুক্তিযুদ্ধ: শোকেপূর্ণ গৌরব ও অহংকারের ইতিহাস

১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর; বাংলাদেশ তখন বিজয় অর্জনের দ্বারপ্রান্তে; এমন সময়ে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল চেতনায় অগ্রগামী জনপদ মানিকগঞ্জের ‘তেরশ্রী’ আক্রান্ত হলো পাক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর দ্বারা। সেদিন কাকডাকা ভোরে রাজাকারদের সহায়তায় পাক বাহিনী ঘিরে ফেলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত তেরশ্রী গ্রাম।

ঘরে ঘরে ঘুমন্ত মানুষের উপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে, আগুন জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়া হয় পুরোটা গ্রাম। এসময় গ্রামের ৪৩ জনকে গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে, বেয়োনেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এতোগুলো নিরপরাধ মুক্তিকামী মানুষের লাশ আর তাজা রক্ত সেদিন স্তব্ধ করে দিয়েছিল তেরশ্রী জনপদকে। শোকার্ত করেছিল পুরো জাতিকে।
 
প্রগতিশীল চিন্তা ও রাজনৈতিক আদর্শের চর্চায় সমৃদ্ধ অঞ্চল তেরশ্রী; পাকহানাদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল সেইসব ব্যক্তিবর্গ যাদের এই গ্রামের শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও বিস্তারে ছিল অপরিসীম অবদান। পাশবিক এই গণহত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামটিকে মেধাশূন্য করা।
 
আধুনিক মারনাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তেরশ্রীতে অতর্কিত হামলা চালায় হায়েনার দল। ঘরে ঘরে ঢুকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে দেশপ্রেমিক কৃষক-শ্রমিক জনতার সাথে শিক্ষক ও সমাজের জ্ঞানী-গুণীজনকে। লুকিয়ে বাঁচতে পারেননি কেউ। বর্বরোচিতভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় তারা হত্যা করে তেরশ্রীবাসী বাংলার দেশপ্রেমিক জনতাকে। রক্তপায়ীর দল উল্লাসে মেতে বরণ করেছিল রক্তাক্ত সকাল।
   
জমিদার সিদ্ধেশ্বরী রায় প্রসাদ চৌধুরী, তেরশ্রী অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইন্সিটিউশন এবং মানিকগঞ্জ জেলার প্রথম কলেজ-তেরশ্রী কলেজসহ এলাকার আরও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বিদ্যোৎসাহী এই ব্যাক্তি ছিলেন ট্র্যাজেডির প্রথম শিকার। প্রথমে গুলি করে, গায়ে কাপড় পেঁচিয়ে পেট্রোল ঢেলে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিলো দানশীল এই মানুষটিকে।

তেরশ্রী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানকে বেয়োনেটে খুঁচিয়ে, চোখ উপড়ে, পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। হানাদাররা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। নিধনযজ্ঞের তালিকায় আরও ছিলেন সাধনকুমার সরকার, বিপ্লবকুমার সাহা, সচীন্দ্রনাথ গোস্বামী, মাখনচন্দ্র সরকার, রমজান আলী, মহেন্দ্র দাস, নিতাইচন্দ্র দাস, শ্যামলাল সুত্রধর, জগদীশচন্দ্র দাস, যোগেশ সূত্রধর, নারায়ণ সূত্রধর, রামচরণ সূত্রধর, দেলবর আলী, মাধব দত্ত, যাদব দত্ত, যোগেশ দত্ত, শ্যামাপদ নাগ, রাজবল্লভ নাগ, গেদা মিয়া, কছিম উদ্দিন, একলাছ মোল্লা, তফিল উদ্দিন, ওয়াজ উদ্দিন, সাধুচরণ দাস, সুধন্য দাস, সুরেন্দ্র দাস, যোগেশ চন্দ্র দাস, গৌড়চন্দ্র দাস, মণীন্দ্রচন্দ্র দাস, শ্রীমন্ত দাস, প্রাণগোবিন্দ সাহা, যোগেশ ঘোষ, জ্ঞাণেন্দ্র ঘোষ, তছিম উদ্দিনসহ আরো সাতজন। মহান শহীদের তাজা রক্তে ভেসে গেছে তেরশ্রী জনপদ।

তেরশ্রী’র গণহত্যাসহ মানিকগঞ্জের এমন আরও অনেক যুদ্ধগাঁথা একাত্তরের প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে গুরুত্ব পায়নি। মুক্তিযোদ্ধারাও পাননি তাঁদের প্রাপ্য সম্মান। এলাকার জনমানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল তেরশ্রীর বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত হবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। রাজনৈতিক-প্রশাসনিক নানাবিধ জটিলতা কাটিয়ে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর ২০১২ সালে তেরশ্রীতে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

তেরশ্রীর নতুন প্রজন্ম জানে না মুক্তিযুদ্ধে পূর্বসূরিদের সেই ইতিহাস, ট্রাজেডি। চলতি পথে নবনির্মিত এই স্মৃতিস্তম্ভের দিকে চোখ পড়লে তারা হয়ত জানতে চাইবে কি ঘটেছিলো সেদিন? কেন ঘটেছিল এই জঘন্য নরহত্যা? নবনির্মিত এই স্মৃতিস্তম্ভটি মৃত্যুঞ্জয়ী ৪৩ জন শহীদের খোদাইকৃত নাম নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকবে কালের গৌরবগাঁথা বেদনার স্বাক্ষী হয়ে। তেরশ্রী গণহত্যাসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে এগিয়ে আসতে হবে দায়িত্বশীল সবাইকে। দেশজুড়ে স্বাধীনতার লড়াই-সংগ্রাম, জীবনদানের বিস্মৃতপ্রায় এইসব বীরত্বগাঁথা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে করবে সমৃদ্ধ ও দেশপ্রেমিক। বাঙালি জাতির ইতিহাসকে করবে গৌরবান্বিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একই সাথে শোকেপূর্ণ গৌরব ও অহংকারের ইতিহাস।

লেখক: একটি বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘন্টা, ২১ নভেম্বর ২০১২
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।