এক ধরনের কূটনৈতিক খেলা দেখা যেত স্নায়ুযুদ্ধের সময়টায়। ন্যাটো আর ওয়ার্শ জোটভুক্ত দেশগুলো গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে পরস্পরের দেশ থেকে পরস্পরের কূটনৈতিকদের বহিষ্কারের খেলায় মেতে উঠতো।
তবে এ ধরনের নাটকের মঞ্চায়ন এখনও মাঝে মধ্যে দেখা যায় বই কি। আবার ঠিক একই ধাঁচে না হলেও ভিন্ন প্রেক্ষিতেও একই ধরনের আচরণ ঘটতে দেখা যায়। যেমন পাকিস্তানি সন্ত্রাসী কাসাবের ফাঁসি কার্যকরের পরপর এ ধরনের একটি নাটক মঞ্চায়নের আভাস পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
মুম্বাই হামলার একমাত্র জীবিত সন্ত্রাসী আজমল কাসাবের (২৫) মৃত্যুদণ্ড বুধবার সকালে কার্যকরের পর ভারতীয় পত্রিকাগুলোতে এ ধরনের খবর বেরোয় যে কাসাবের ‘মৃত্যুর প্রতিশোধ’ পাকিস্তানে বন্দি ভারতীয় সন্ত্রাসী সর্বজিৎ-এর মৃত্যু কার্যকরেরর মাধ্যমে নেবে পাকিস্তান।
এ প্রসঙ্গে একটি হিন্দি অনলাইন পত্রিকা পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির অফিসের ‘কিছু সূত্রের’ উল্লেখ করে লিখেছে, পাকিস্তান সরকার কাসাবের মৃত্যুর বদলা নিতে সর্বজিতের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করবে না— এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
হিন্দি অনলাইনটির মতে, কাসাব প্রসঙ্গে পাকিস্তানি সূত্র বলে, আমরা ভারতীয়দের বিচার প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখি। আমাদের বিশ্বাস, এই সিদ্ধান্ত পুরো খোঁজ-খবর আর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমেই হয়েছে। তবে আমাদেরকে এটাও স্বীকার করতে হবে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী কাসাবের প্রাণভিক্ষার আবেদনে সিদ্ধান্ত দিতে খুব তাড়াহুড়া করেছেন। আর কাসাবের প্রাণদণ্ড কার্যকরের বিষয়টিও শেষ সময় পর্যন্ত খুব গোপন রাখা হয়। তাই বলা যায়, এর আসর সর্বজিতের ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনের ফয়সালার ওপর পড়তে পারে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন সর্বজিৎ (৪৯)। ওই বোমা হামলায় ১৪জন নিহত হন। মামলার রায়ে সর্বজিৎকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। এরপর পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতির কাছে সর্বজিতের পক্ষ থেকে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়। ওই আবেদনে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।
উল্লেখ্য, বহুল আলোচিত মুম্বাই হত্যাযজ্ঞ পরিচালনাকারী একমাত্র জীবিত পাকিস্তানি জঙ্গি আজমল কাসাবের ফাঁসি চরম গোপনীয়তায় বুধবার সকাল সাড়ে ৭টায় মহোরাষ্ট্রের পুনের ইরাওয়াদা কারাগারে কার্যকর করা হয়।
গত ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছে কাসাবের প্রাণভিক্ষা চেয়ে করা আবেদনটি নামঞ্জুর হওয়ার পর এ রায় কার্যকর করা হলো।
ভারতীয় মিডিয়ার খবরে জানা গেছে, সাধারণের দৃষ্টিতে কাসাবের মৃত্যুদণ্ড খুব হঠাৎ কার্যকর হলেও বিষয়টি অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়। এজন্য গঠন করা হয় ১৭ সদস্যের কার্যকরি কমিটি। এরমধ্যে ওই টিমের ১৫ জন সদস্যের সেলফোন গত কয়েকমাস ধরে বন্ধ রাখা হয়। সরকারের পরিকল্পনা ছিল এমনভাবে কাসাবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে যাতে সংশ্লিষ্টরা ছাড়া বাইরের কাকপক্ষীও আগে থেকে টের না পায়।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর কাসাব ও তার অস্ত্রধারী সঙ্গীরা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুম্বাইয়ের কয়েকটি গুরুতব্পূর্ণ স্থাপনায় আক্রমণ করে। হামলায় শামিল মোট ১০ জঙ্গির মধ্যে একমাত্র জীবিত হিসেবে পাকড়াও হয় কাসাব। বাকিরা ভারতীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা কমান্ডো হামলায় নিহত হয়।
ওই ঘটনায় মুম্বাইয়ের বিলাসবহুল হোটেল তাজমহল ও ওবেরয় ট্রাইডেন্ট, শহরের মূল রেলস্টেশন ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস ও একটি ইহুদি কেন্দ্রে হামলা করে জঙ্গিরা। এ ঘটনায় ১৬৬জন নিহত হয়। কাসাব ও তার সঙ্গীরা প্রায় তিনদিন ধরে মুম্বাই নগরীর উল্লেখিত এলাকাগুলো অবরুদ্ধ করে রাখে, সৃষ্টি হয় এক নারকীয় পরিস্থিতির।
অভিযুক্তদের মধ্যে একমাত্র জীবিত আজমল কাসাবের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের মে মাসে হত্যা, ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়াসহ ৮০টি অভিযোগ আনা হয়। মামলা চলাকালে কাসাবের ডিএনএ, আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিডিও ফুটেজ থেকে প্রমাণিত হয় যে তার ছুড়ে মারা এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমায় বহু মানুষের করুণ মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, ইসলামাবাদের ভারতীয় দূতাবাস চিঠির মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারকে কাসাবের ফাঁসির খবর জানালেও কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে। পরে ফ্যাক্স করে ঐ চিঠি পাঠানো হয়।
এরপর এক আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, যে কোনো ধরনের চরমপন্থি তৎপরতার বিরোধীতা করে পাকিস্তান। আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অপর দেশের সঙ্গে সে সহযোগিতা করবে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছে কাসাবের প্রাণভিক্ষা চেয়ে করা আবেদনটি নামঞ্জুর হওয়ার পর এ রায় কার্যকর করা হলো।
রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হওয়ার পর লস্কর-ই-তাইয়্যেবার এ সদস্যকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মুম্বাইয়ের আর্থার রোডের জেল থেকে পুনের কারাগারে আনা হয়।
২০০৮ সালে গ্রেফতারের পর থেকেই কাসাবকে মুম্বাইয়ের আর্থার রোডের জেলের বুলেটপ্রুফ সেলে রাখা হয়।
ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই, হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো সহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গত বছরের অক্টোবরে মুম্বাইয়ের হাইকোর্ট তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
কাসাব ন্যায়বিচার পায়নি দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেও চলতি বছরের আগস্ট মাসে তার আবেদনটি খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৯ ঘণ্টা, ২১ নভেম্বর, ২০১২
একে; সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com