পারস্য সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে ইরানের বুকজুড়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে শিল্প, স্থাপত্য ও সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন—পার্সেপোলিস বা তাখতে জামশিদ। এ যেন সময়ের বালুকণার ওপর খোদাই করা অমর কাব্য।
সময়ের স্রোতে পার্সেপোলিস
খ্রিস্টপূর্ব ৫১৮ সালে পারস্যের হাখামানেশীয় সম্রাট দারিয়ুস প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক রাজধানীর, যা কেবল রাজকীয় প্রাসাদের সমাহার নয়, বরং সমগ্র সাম্রাজ্যের শক্তি, ঐক্য ও মহিমার প্রতীক হবে। সেই স্বপ্ন থেকেই জন্ম নেয় পার্সেপোলিস। ইরানিরা পার্সেপোলিসকে ‘তাখতে জামশিদ’ নামে অভিহিত করে থাকে। এখানে পারস্যের সম্রাটরা শুধু শাসনকাজ পরিচালনা করেননি, আয়োজন করতেন মহাসমারোহের—বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দূতেরা আসত, বহন করত উপঢৌকন। জাঁকজমকপূর্ণভাবে ফার্সি নববর্ষ বা নওরোজ উৎসব হতো এখানে।
পার্সেপোলিসে দর্শণার্থীদের ভিড়
প্রাসাদের মহিমা
রাজপ্রাসাদটি ‘কুহ-ই রহমত’ বা ‘দয়ার পাহাড়’ নামের পর্বতমালার সুউচ্চ চূড়ার পাদদেশে মারভদাস্ত সমভূমির প্রান্ত সীমায় অবস্থিত। পার্সেপোলিসের আয়তন একলক্ষ পঁচিশ হাজার বর্গমিটার। বিশাল এক উঁচু মঞ্চের ওপর নির্মিত হয়েছিল এই রাজকীয় নগরী। আধা-প্রাকৃতিক, আধা-কৃত্রিম মঞ্চটি প্রায় ১৩ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। তার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল রাজকীয় প্রাসাদসমূহ, অভ্যর্থনা কক্ষ, সিংহাসন হল, সিঁড়ি ও ভাস্কর্যে অলংকৃত প্রবেশদ্বার।
তেত্রিশ খিলানের উপর স্থাপিত প্রাসাদগুলোর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ছিল ‘আপাদানা প্রাসাদ’। এই প্রাসাদই ছিল রাজ-অভ্যর্থনা কক্ষ। সেই আড়াই হাজার বছর আগে কত নিপুণভাবে, কত শৈল্পিকভাবে এই প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছে, ভাবতেও অবাক লাগে।
স্থাপত্যের বিস্ময়
পার্সেপোলিসের স্থাপত্য নিছক শক্তির প্রদর্শনী নয়; এটি ছিল প্রকৌশল ও শিল্পকলার এক অনন্য সংমিশ্রণ। কাঠের বিম ও হালকা ছাদের মাধ্যমে স্থপতিরা এমন সরু স্তম্ভ ব্যবহার করেছিলেন, যা আজও স্থাপত্য ইতিহাসে বিস্ময়কর। স্তম্ভের মাথায় বসানো ডাবল-বুল ক্যাপিটাল—দুইটি বিশাল ষাঁড় পিঠ-থেকে-পিঠে বসে যেন পুরো ছাদের ভার বহন করছে—হাখামানেশীয় শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন।
জেরক্সেস গেইট
কমপ্লেক্সে ঢোকার পথে প্রথমেই নজরে পড়ে জেরক্সেস বা খাশাইয়ারশাহ গেইট। এই গেইটটিকে ‘গেইট অব অল নেশন’ বা সর্বজাতিক তোরণও বলা হয়। তোরণের দেয়ালে খোদাই করা কিছু লেখা দেখতে পাওয়া যায়। তিনটি ভাষায় এগুলো লেখা হয়েছে। এইসব শিলালিপিতে যা লেখা হয়েছে তার অর্থ হলো— ‘দর্শনার্থী এবং ভ্রমণকারীদের প্রতি ভদ্রোচিত ও সদয় আচরণ করুন’ এবং ‘অপরাপর সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করুন’। বিশ্বজনীন এই সৌজন্য বাণীই প্রমাণ করে যে, এখানকার কর্তৃপক্ষ কতটা অতিথিপরায়ণ, বিনম্র ও উদার মানসিকতার অধিকারী।
আপাদানা প্রাসাদে ষাঁড়, সিংহ ও পৌরাণিক প্রাণীর ভাস্কর্য ছিল
আপাদানা প্রাসাদ
পার্সেপোলিসের ‘আপাদানা প্রাসাদ’ ছিল হাখামানেশীয় সাম্রাজ্যের অন্যতম বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ রাজপ্রাসাদ, যা দারিয়ুস প্রথম (খ্রিস্টপূর্ব ৫২১-৪৮৬) নির্মাণ শুরু করেন এবং জেরক্সেস প্রথম সম্পূর্ণ করেন। এই প্রাসাদ মূলত রাজকীয় দরবার ও আনুষ্ঠানিক সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত হতো, যেখানে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত দূত, শাসক ও প্রতিনিধিরা সমবেত হয়ে রাজাকে শ্রদ্ধা জানাতেন।
‘আপাদানা’ শব্দের অর্থ হলো ‘দরবার কক্ষ’। আপাদানা প্রাসাদের আয়তন ছিল প্রায় ১০০০ বর্গমিটার। ছয় সারিতে সাজানো ৩৬টি উঁচু স্তম্ভ ছাদকে ধরে রেখেছিল এবং প্রতিটি বারান্দায়ও একই উচ্চতার ১২টি স্তম্ভ (দুটি সারিতে ছয়টি করে) ছিল।
প্রাসাদের চারপাশে খোদাইকৃত বিশাল পাথরের সিঁড়িতে নানা জাতি ও অঞ্চলের প্রতিনিধিদের ২৩টি মানবমূর্তি খোদাই করা আছে, যা হাখামানেশীয় সাম্রাজ্যের বহুজাতিক চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। কোন দেশে কীরকম পোশাকের প্রচলন রয়েছে এবং কারা কী ধরনের অস্ত্র বহন করে, সেগুলো একনজরে বোঝানোর জন্যে এই প্রদর্শনীর আয়োজন। আপাদানা প্রাসাদের স্তম্ভগুলো ছিল ২০ মিটারেরও বেশি উঁচু, যার মাথায় ষাঁড়, সিংহ ও পৌরাণিক প্রাণীর ভাস্কর্য ছিল। আজও এই ধ্বংসাবশেষ ইরানের সমৃদ্ধ ইতিহাস, শিল্পকলা ও রাজনৈতিক মহিমার এক অনন্য সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আপাদানা প্রাসাদের একটি ভাস্কর্য: সিংহ আক্রমণ করছে একটি ষাঁড়কে
প্রাচীন ইরানি বিশ্বাসের চিহ্ন
পার্সেপোলিস ঘুরে ফিরে দেখলে খুব সহজেই জরাথ্রুস্ট ধর্মের কিছু প্রতীক আবিষ্কার করা যায়। সেখানে দেখা যায় জরাথ্রুস্ট ধর্ম তথা অগ্নি উপাসকদের ঈশ্বর আহুরামাযদার প্রতীকী ভাস্কর্য। এই প্রতীকটি প্রাসাদের বিভিন্ন স্থানে দেখতে পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও এমন আরও কয়েকটি প্রতীক এখানে দেখা যায়, যেগুলো জরাথ্রুস্টদের কাছে ধর্মীয় কারণে অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। এসব প্রতীকের আবার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাও রয়েছে। যেমন সিংহ হলো আগুনের প্রতীক। ষাঁড় হলো পৃথিবীর প্রতীক। পদ্মফুল পানির প্রতীক এবং ঈগল বায়ুর প্রতীক। মজার ব্যাপার হলো পার্সপোলিসের অভ্যন্তরে চমৎকার একটি ভাস্কর্য সবার নজরে পড়বে। ভাস্কর্যটি প্রতীকী। একটি সিংহ আক্রমণ করছে একটি ষাঁড়কে। এই ভাস্কর্যটি হলো ইরানের নববর্ষ বা নওরোজের প্রতীক।
টাচার প্রাসাদ
টাচার প্রাসাদ
পার্সেপোলিস মঞ্চে প্রথম যে প্রাসাদগুলোর একটি নির্মিত হয়েছিল, তার মধ্যে দক্ষিণমুখী (সূর্যের দিকে মুখ করা) এই প্রাসাদটি আপাদানার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। ‘টাচার’ শব্দের অর্থ ফার্সি ভাষায় ‘শীতকালীন গৃহ’। এই প্রাসাদের পাথরগুলো মসৃণভাবে পালিশ করা, এজন্য একে ‘আয়নার হল’ নামেও ডাকা হয়। এই প্রাসাদটি দারিয়ুসের ছিল।
অভ্যন্তরীণ আঙিনা (বর্তমান জাদুঘর)
এই প্রাসাদটির পরিকল্পনা ইংরেজি বর্ণ ‘এল’ আকৃতির এবং এর দুটি ডানা জেরক্সেস প্রাসাদের দক্ষিণে এবং ভাণ্ডারের পশ্চিমে বিস্তৃত। প্রাসাদটি চারপাশে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল এবং এর মাত্র একটি ছোট প্রবেশপথ ছিল উত্তর-পশ্চিম কোণে। এই কারণে এর নামকরণ হয়েছিল হারেম। এই বিন্যাস নির্দেশ করে যে, প্রাসাদটির কার্যক্রম এমন ছিল যেখানে বাইরের মানুষ প্রবেশ করতে পারতেন না।
ধ্বংসের কালরাত্রি
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’-এর আক্রমণে ধ্বংস হয় হাখামানেশীয় সাম্রাজ্যের জাঁকজমকপূর্ণ রাজধানী পার্সেপোলিস। গ্রিকদের কাছে পার্সেপোলিস ছিল পারস্য শক্তি ও গৌরবের প্রতীক, তাই শহরটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও আধিপত্যের ঘোষণা হিসেবে। বলা হয়ে থাকে, বহু বছর আগে পারসিকরা এথেন্স জ্বালিয়ে দিয়েছিল, আর আলেকজান্ডার সেই প্রতিশোধ নিতেই পার্সেপোলিসকে আগুনে পুড়িয়ে দেন। তবে, ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে—কেউ বলেন এটি ছিল আলেকজান্ডারের পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত, আবার কেউ মনে করেন নৃত্য-গান ও মদের আসরে মত্ত হয়ে হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তেই এই অগ্নিসংযোগ ঘটেছিল। ধ্বংসের সময় সৈন্যরা শহরের বিপুল ধনসম্পদ লুট করে নেয়, আর আগুনে প্রাসাদগুলোর কাঠের ছাদ, সজ্জা ও অমূল্য শিল্পকর্ম ভস্মীভূত হয়। কিংবদন্তি বলে, অগ্নিস্নাত রাতের পর আকাশ লাল হয়ে উঠেছিল। নগরীর একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আকাশ থেকে পার্সেপোলিস
পুনর্জাগরণ ও বিশ্ব ঐতিহ্য
১৯৩০-এর দশকে পার্সেপোলিস নতুনভাবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যখন ইরানে ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ শুরু হয়। জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ আর্নস্ট হার্ৎসফেল্ড এবং পরে এরিখ শ্মিড্ট-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এই খননে ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে হাখামানেশীয় সাম্রাজ্যের প্রাচীন রাজধানীর অবশিষ্ট মহিমা। আবিষ্কৃত হয় রাজপ্রাসাদ, ভাস্কর্য, খোদাই করা সিঁড়ি, রাজকীয় সিলমোহর ও শিলালিপি, যা সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করে। এই খননকাজ পার্সেপোলিসকে শুধু ইরানের নয়, সমগ্র মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো পার্সেপোলিসকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ইউনেস্কোর ভাষায়, পার্সেপোলিস এমন এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ‘যার কোনো তুলনা নেই এবং যা প্রাচীন সভ্যতার অনন্য সাক্ষ্য বহন করে। ’
পার্সেপোলিসে দর্শণার্থীরা
ভ্রমণকারীর অনুভূতি
পার্সেপোলিস কেবল পুরাতাত্ত্বিক বা ইতিহাসবিদদেরই গবেষণার বিষয় নয়, স্থপতিদের গবেষণার জন্যও বিস্ময়কর এক অনন্য স্থাপনা এটি। আর সেজন্যই দেশি-বিদেশি পর্যটক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, স্থপতি এবং পুরাতাত্ত্বিকদের আগমনে সর্বদাই জমজমাট থাকে এই পার্সেপোলিস।
পার্সেপোলিসে পা রাখলেই অনুভূত হয়, আপনি যেন ইতিহাসের ভেতর দিয়ে হাঁটছেন। সূর্যাস্তের আলোর সঙ্গে কুহ-এ রহমতের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা খোদাইকৃত ষাঁড় ও সিংহদের দিকে তাকালে মনে হয়, তারা এখনো পাহারা দিচ্ছে পারস্যের রাজাদের মহিমাকে। বাতাসে যেন হাজার বছর আগের উৎসব, নৃত্য ও সঙ্গীতের নানান সুর ভেসে আসে। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি স্তম্ভ ও ভাস্কর্য যেন প্রশ্ন করে—“সভ্যতা চলে যায়, কিন্তু তার গল্প কি মুছে যায়?”
পার্সেপোলিস কেবল ধ্বংসাবশেষ নয়; এটি এক জীবন্ত স্মৃতিসৌধ, যেখানে প্রতিটি পাথর, প্রতিটি খোদাই আপনার চোখে ইতিহাসের গল্প বলে। এখানে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, মানুষ সভ্যতা গড়ে তোলে, শক্তিশালী সাম্রাজ্য তৈরি করে, আবার ধ্বংসও হয়, কিন্তু তার স্মৃতি চিরকাল বেঁচে থাকে। কুহ-এ রহমতের পাদদেশ থেকে সূর্যাস্তের আলোয় ভাস্কর্যগুলো দেখলে মনে হয়, পার্সেপোলিস আজও বলে—“আমি ছিলাম, আমি আছি এবং আমি মানবজাতির স্মৃতিতে চিরকাল বেঁচে থাকব। ” এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এক অদ্ভুত সজীবতা আছে, যা শুধু চোখে দেখা নয়, হৃদয়েও অনুভূত হয় এবং প্রতিটি দর্শককে ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করে।
এমজেএফ