আপাতদৃষ্টিতে জনসংস্কৃতি (popular culture) ও গণসংস্কৃতি (mass culture) একই মনে হলেও শব্দ দুটির মধ্যে অর্থ ও ব্যবহারিকতায় বেশ ফারাক রয়েছে। একটি যদি হয় আমজনতার সংস্কৃতির প্রতিনিধি তবে দ্বিতীয়টির মধ্যে ক্ষমতা ও বিনোদনের ভোক্তাশ্রেণি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
ক্ষমতা কাঠামোর বিচারে জনসংস্কৃতির মূল্য কতটুকু? পুঁজিবাদী সমাজে আদতে কি জনগণের হাতে কোনো ক্ষমতা থাকে? সমাজে সংস্কৃতির যে বিভিন্ন স্তর সেখানে জনসংস্কৃতির জায়গাটাকে আমরা চিহ্নিত করছি বহুল ও বৃহত্তর এক গোষ্ঠীকে, যারা অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর ও সাংস্কৃতিভাবে অমূল্যায়িত। কিংবা আধিপত্যবাদী ক্ষমতার হাতে পিষ্ট। বিখ্যাত ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়েরে বুর্দোর এক উক্তি উল্লেখ করা যাক এই প্রসঙ্গে, ‘যাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোনো মূলধন নেই জনসংস্কৃতি তাদেরই। ’ আমি এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূলধনকেও যোগ করতে চাই।
যেহেতু ক্ষমতা নেই, এই জনসংস্কৃতিকে আপনি চাইলে উচ্চবিত্তের ড্রয়িংরুমে বসেও বিভিন্নভাবে পরিচালিত ও প্রভাবিত করতে পারেন। এবং সেটি আরও বেশি হয়ে আসছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কালে। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরে প্রেক্ষাপট ও নতুনত্বের সন্ধানে ১৯৬০ দশকের দিকে পশ্চিমে তো বটে বাংলাদেশেও বৃহত্তরভাবে ছড়িয়ে পড়ে জনসংস্কৃতির ধারণা। যা ভেঙে দিয়েছিল সো-কলড উচ্চ ও নিম্নসংস্কৃতি চেতনার দেয়ালকে। কমিক বুক, রেডিও, টেলিভিশন উচ্চবিত্তের ড্রইংরুম ছেড়ে জনসংস্কৃতিরও প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করে। পরের দশকগুলোতে সেসবের আরও বিস্তার লাভ হয়। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পরবর্তীতে যোগ হয় ইন্টারনেটও। ই-মেইল যুগ পেরিয়ে এখন আমাদের হাতের মুঠোয় ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। প্রশ্ন হলো, শেষ পর্যন্ত এসব কতটুকু জনসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পেরেছে?
ঊনিশ শতকে ইংল্যান্ডে যে শিল্পবিপ্লব ঘটে সেটির প্রভাবে গোড়াপত্তন আজকের নিঃসঙ্গতায় ভরা নগরসংস্কৃতির। মানুষ কৃষি ছেড়ে হয়ে উঠেছে শ্রমিকশ্রেণি। কৃষি ও কৌম সমাজের হৃদ্যতা ও অবসর বলে যেটুকু ছিল, তা যেন হারিয়েই গেছে। শিল্পোন্নয়নের ফলে নাগরিক সংস্কৃতির ঢেউ শুরুতে শহুরে জীবনে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সেটি গ্রামগুলোতে বেশ ভালোভাবে ছড়িয়েছে। এর ভালো ও খারাপের দুই দিকই রয়েছে।
একসময় পপ কালচারের জনপ্রিয় বিষয়গুলোই এখনকার প্রজন্মের কাছে পানসে লাগতে পারে। মূলধারার সংস্কৃতি বলে প্রচলিত যেকোনো কিছুকেই এখন বিশাল এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আপনার হাতে একটি স্মার্ট ফোন থাকা মানে এখন প্রান্তে বসেও অন্যের সঙ্গে মানসিক ও সাংস্কৃতিক সেতু গড়ার পাশাপাশি নতুন ভাবনার উদ্রেক করতে পারছেন। কালাচারাল হেজিমোনি (cultural hegemony) বা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের কাছে মাথা নোয়াতে হচ্ছে না। জনসংস্কৃতি বলতে, একসময়ের বটতলার পুঁথি থেকে শুরু করে লোকজ গান, পালা, যাত্রা, কীর্তনের যে প্রভাব ছিল সেসবের এপিটাফ লেখাও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সংস্কৃতি অবশ্য ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এক জীবন্ত নদী। টিকটক দিয়ে হোক ইউটিউবে বিভিন্ন জনপ্রিয় কন্টেন্ট বানানো কিশোর বা তরুণ প্রজন্মকে এড়িয়ে গেলেও সামাজিকভাবে তাদের অস্বীকার করা যাবে না। এক সময় পপ কালচার উচ্চ ও অভিজাতশ্রেণির কাছে ‘অ্যান্টিকালচার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এখন ফেসবুক-টুইটারের ছোট ছোট রিল ভিডিওগুলো তার প্রতিনিধিত্ব করছে না ঠিক, তবে জনসংস্কৃতিতে তার প্রভাব রাখার পাশাপাশি ভোক্তাশ্রেণি তৈরি করে ফেলেছে। অর্থনৈতিকভাবে যে সংস্কৃতির বাজারমূল্য রয়েছে সেটির টিকে থাকার সম্ভাবনা ততটুকু। এই নয় যে, গত শতকে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি আর টিকে নেই বা মূল্য হারিয়েছে। বরং বলা ভালো, বিভিন্ন কারণে তার চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। শতকের পর শতক পেরিয়ে গেলেও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির শিল্পকর্ম ‘মোনালিসা’র দাম উল্টো বেড়েছে। ভিঞ্চি এই মাস্টাপিস আঁকতে সময় নিয়েছিলেন চার বছর। কিন্তু এখনকার মেশিনযুগ হয়তো হুবহু চার দিনেই মোনালিসা এঁকে ফেলতে পারে। কিন্তু ধারণার যে অনন্যতা সেটি তো আর দিতে পারছে না। সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক কন্টেন্ট দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তরুণ উচ্চবিত্তের কালচারকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারছে বটে, তবে তার শিল্পমূল্য কতটুকু? প্রয়াত সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা এক সাক্ষাৎকারে এক যথার্থ কথাই বলেছেন, ‘মূল্যবান জিনিস পপুলার না হলেও কোনো ক্ষতি নেই এবং লোক বোঝে বলেই এটা মূল্যবান। ’
ফেসবুক-ইউটিউব যুগে সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে আমজনতার। এর ভেতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে নিজেদের চাহিদামতো বা প্রতিনিধিত্বশীল সংস্কৃতি। একসময় টিভি পর্দায় যে কিশোর বা কিশোরীটি তার স্বপ্নের আইডলকে দেখত, এখন সে-ও মুহূর্তেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের আইডল হয়ে উঠছে। এমন নয় যে, এসব কেবল নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে হচ্ছে। তবে নাগরিক ও প্রান্তিক জনসংস্কৃতির ওপর তাদের যে প্রভাব সেটি অবশ্য মাপতে হচ্ছে জনপ্রিয়তার দাঁড়িপাল্লায়। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাইরাল সংস্কৃতিকে ইমেজ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়ে উঠেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্মের ধ্যানজ্ঞান। সামাজিক মূল্যবোধ বা রুচির দোহাই দিয়ে আসলে তাদের বিবেচনা করা অন্যায়। আদতে গণরুচি শেষপর্যন্ত সাময়িকভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু তার স্থায়িত্ব ও স্থানিক প্রতিবেশ একসময় হ্রাস হয়ে যায় এবং নতুনভাবে আবারও ভিন্ন মাধ্যমে ভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। জনসংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারলে বা কথা বলতে না পারলে পরোক্ষভাবে তা আধিপত্যবাদের ছায়াতলে থেকে তারই প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে। তখন সবকিছুই বিনোদন হয়ে দাঁড়ায়, জনচেতনা গড়ে ওঠে না আর।
উপল বড়ুয়া: কবি, লেখক ও সাংবাদিক
এমজেএফ