ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

দু হাত নেই, তবুও সেরা টনি

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৪৫, মার্চ ২৭, ২০১৩
দু হাত নেই, তবুও সেরা টনি

১৯৮৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রে পোপ দ্বিতীয় জন পল একটি অনুষ্ঠানে এসেছেন।

এখানে টনি নামে এক ছেলে গান গাওয়ার জন্য মঞ্চে উপস্থিত। টনিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিউজিক হাউজগুলো চেনে। কিন্তু পোপের কাছে টনি একেবারেই অচেনা।

পোপ জন পল অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখে তার পানি জমে গেল। অসাধারণ মুগ্ধতায় তিনি গান শুনছেন। মুগ্ধতার সঙ্গে বিস্ময়ে ভরা চোখ ছিল টনির দিকে। কারণ টনির দু হাত নেই। পা দিয়ে গিটার বাজাচ্ছে এবং অসাধারণ মধুর কণ্ঠে গান গাচ্ছে। গান শেষ হলো। পোপ মঞ্চে উঠে এলেন। অশ্রুভেজা চোখে টনিকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন।

এ মুহূর্তই বদলে দিল টনির জীবন। এ সম্পর্কে টনি বলেছিলেন, এটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। সেদিন মনে হয়েছিল আমার জীবন সত্যিই সার্থক।

ছোটবেলা থেকেই হাত নেই টনির। জন্মের আগেই মা কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। এ কারণে প্রচুর ওষুধ সেবন করতে হয়। যে ওষুধের প্রভাব পড়ে গর্ভে থাকা টনির ওপর। টনি পৃথিবীর আলো দেখে ঠিকই কিন্তু ততক্ষণে মায়ের মুখটি গম্ভীর হয়ে পড়ে। দু হাত ছাড়া এক ছোট্ট শিশু মায়ের দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মা সেদিন চোখ বন্ধ করে ছেলের জন্য প্রার্থনা করেন। এ ছেলে যেন হাত ছাড়াই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। মায়ের কথা কি সৃষ্টিকর্তা ফেলতে পারেন? ১৯৬৫ সালে জন্ম নেওয়া টনি এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় গিটার বাদকদের একজন।
Tony_
টনির ছোটবেলাটা খুব কষ্টের। হাত নেই; তাই বলে জীবন তো থেমে থাকবে না। লড়তে হবে। ছেলেকে লড়ে যাওয়ার মতো সব ধরনের সহযোগিতা করে তার মা। ছেলের জন্য কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা করা হয়। স্কুল পর্যন্ত টনি বিষয়টি নিয়ে খুব একটা কথা বলেনি। কিন্তু ১০ বছর বয়সে হুট করেই মাকে বলেন, আমি এ হাত লাগাতে চাই না। আমি অস্বস্তিবোধ করছি।

মায়ের মনটা সেদিন বিষাদে ছেয়ে যায়। ছেলের জন্য মায়া হয়। টনি বিষয়টি বুঝতে পেরে মাকে বলে, তুমি চিন্তা করো না মা। হাত নেই তো কি হয়েছে? পা আছে। আমার পা দুটিই হাতের কাজ করবে।

তারপর থেকেই টনির অন্যরকম যুদ্ধ। টনি হাইস্কুল থাকতেই গিটার বাজাতে শুরু করেন। গান শুনতে ও গাইতেও ভালোবাসতেন। এ জন্য গিটারের প্রতি তার অসীম আগ্রহ ছিল। পা দিয়ে গিটার বাজাতে পারদর্শী হওয়ার আগেই তিনি গান লিখায় হাত দেন। এরপর থেকে নিজের গান নিজেই লিখতেন। নিজে সুর দিয়ে গিটার বাজিয়ে গাইতেন।

বন্ধুদের প্রতি টনির অকৃত্রিম ভালোবাসা। বন্ধুরা তাকে সব সময়ই সাহায্য করে এসেছে। বিশেষ করে টনির ভাই তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করত। টনি যখন ক্লাসে গম্ভীর হয়ে পড়ে থাকতো, তখন তার ভাই টনিকে এসে বলত, ভাইয়া চলো, সবাই খেলছে। আমরাও খেলবো।

টনি তখন ভাইয়ের মমতার কাছে হার মানতেন। টনি এসব সম্পর্কে বলেছিল, জীবনের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে আমার ভাই ও বন্ধুরা।

এক সময় টনি ধর্ম যাজক হতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছু নিয়মনীতির কারণে তা হতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েন টনি। ধর্ম যাজক না হতে পারলেও চার্চের সঙ্গে থাকার সুযোগ বেছে নেয়। একজন গিটারিস্ট হিসেবে চার্চের সেবা করার সুযোগ পায় টনি। এতেই সে খুশি। টনি নিজের মিউজিক দল তৈরি করে। একদিন মিউজিক করার সময় শুনলেন পোপ জন পল দ্বিতীয় আসবেন।

এ ঘটনা প্রসঙ্গে টনি বলেছিলেন, হুট করেই একদিন আমাকে চার্চের এক বৈঠকে ডেকে পাঠানো হয়। তখনও বুঝতে পারিনি কি হতে যাচ্ছে। সাধারণত চার্চের কোনো বৈঠকে আমাকে ডাকার কথা নয়। তবু গেলাম। যখনই শুনলাম পোপের সামনে গান গাইতে হবে তখন এতো খুশী লাগছিল বলে বোঝাতে পারব না।

পোপ চার্চে আসলেন। আমি গান গাইলাম। হুট করেই আমাকে বার্তা দেওয়া হলো, যেন মঞ্চ থেকে না সরি। ভাবছিলাম নিরাপত্তার কোনো বিষয় হবে হয়তো। কিন্তু না; দেখলাম পোপ নিজ পায়ে মঞ্চে উঠে আসলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিলেন। তখন কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল বোধহয় স্বপ্নই দেখছি।

এরপর থেকে টনিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রীতিমত সেলিব্রিটি বনে গেছেন। বিশ্ব মিডিয়ার নজর কাড়েন হাতবিহীন এ মানুষটি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি চার্চের গিটারিস্ট হয়ে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হন। আবার পোপের আমন্ত্রণে ভ্যাটিকান সিটিতেও অনুষ্ঠান করতে যান টনি। ১৯৮৯ সালে নিজের অ্যালবাম করে আলোচনার তুঙ্গে উঠে আসে টনি।

টনিকে নিয়ে মিডিয়ায় নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এমনকি লেখকেরা তার জীবনের ওপর লেখাও শুরু করেন। এতে করে টনি খুব একটা বিচলিত হন না। তিনি তার জীবন সম্পর্কে বলেন, আমার জীবনের কষ্টগুলো কোনো সাধারণ মানুষ বুঝবে না। কেউ বোঝেনি। একবার আমি প্রেমে পড়েছিলাম।

কিন্তু সেই প্রেম পাওয়া হয়নি। এ নিয়ে ওই মেয়েটির প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই। কেউ তো চাবে না তার জীবনসঙ্গী হাতবিহীন হোক। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটি যে আমার ভেতর প্রচণ্ড কষ্টের সৃষ্টি করে তা কেউ বুঝবে না।

টনি কিন্তু জীবনের কাছে হেরে যেতে শিখেনি। সে এখনও গিটার বাজায়। মানুষকে বিনোদন দেয়। জীবনকে অনুভব করেন। ভালোবাসেন। যুদ্ধ করেই টনি জয়ী হয়েছেন। এমনকি পোপের আর্শিবাদও আজ টনির জীবনসঙ্গী।

বাংলাদেশ সময় ১৯২৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক/ সাব্বিন হাসান

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।