ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মেঘের রাজ্য অরুণাচল

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৫১, মার্চ ২৭, ২০১৩
মেঘের রাজ্য অরুণাচল

ঢাকা: আসামের তেজপুর শহরে বেড়াতে গিয়ে শুনলাম, ওখান থেকে অরুণাচলের বমডিলা শহরটি বেশি দূরে নয়। ভাবলাম, দেখে আসি বমডিলা।

সন্ধ্যার পর পর এসে পৌঁছলাম বমডিলায়।

সড়কপথে বাসে সেখানে পৌঁছাতে ৬ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। খুব সকালেই আমাদের ঘুম ভাঙলো। এবারে আমার সফরসঙ্গী ছিল গৌহাটির পত্রবন্ধু পলাশ রায়। উঠেছিলাম সরকারি ট্যুরিস্ট লজে।

এখানে দু’জন থাকার জন্য রুম ভাড়া নেয়া হলো ৪০০ টাকা। ওখানে গিয়ে শুনলাম, বমডিলার আরেক নাম ‘কামেং’। এই বমডিলা মেঘের দেশ। এখানে সকালের দিকে আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো এলাকাটিই মেঘের দখলে চলে যায়।

বের হলাম বমডিলার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে। হেঁটে হেঁটে দেখে নিলাম পর পর কয়েকটি বৌদ্ধমন্দির। ক্র্যাফট সেন্টারে ঢুকে চোখে পড়ল মিজি উপজাতীয়দের তৈরি কত ধরণের হস্তশিল্প। এসব দেখে তাক লেগে গেল।

একটু এগিয়ে যেতেই দেখি বমডিলার উপজাতীয় লোক সংস্কৃতির মিউজিয়াম। এটি ঘুরে দেখতে দেখতে দুপুর ১টা বেজে গেল। ওখান থেকে এলাম বৌদ্ধমন্দিরে। এখানে একটি মঠও দেখলাম। এক গাইডের মুখে শুনলাম, ১৯৬২ সালে এক তিব্বতি লামার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি।

বিকালে এলাম বমডিলার গাঁয়ের পথে। এসে দেখি আপেলের বাগান। প্রতিটি গাছে ভরে আছে আপেল। ওখানেই আমাদের পরিচয় হলো মিজি উপজাতীয় একটি ছেলের সঙ্গে। নাম তুষার মিজি। গাছ থেকে কয়েকটি আপেল ছিঁড়ে আমাদের হাতে তুলে দিল।

সে মুহূর্তে মনে হলো, মিজি উপজাতি কতই না সহজ-সরল। প্রাকৃতিক শোভাই বমডিলার প্রধান সম্পদ। পাহাড় আর অরণ্য মিলে এখানে রচনা করেছে এক অপার্থিব সৌন্দর্য। সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম হোটেলে।

সন্ধ্যার পর এখানে তাপমাত্রা দ্রুত নেমে যায়। তাই আর বের হলাম না। আগেই জানা ছিল অরুণাচলের রাজধানী ইটানগর। এখানে ১৩টি জেলা শহর, যেমন তাওয়াং, বমডিলা, সেপ্পা, জিরো, দাপোরিজো, ইংকিয়ং, আনিনি, পাসিঘাট, তেজু, জিরো, ইটানগর, আলং সিয়াং।

রাত ৯টায় রুমে এলেন একজন গাইড। তিনি জানালেন, আগামীকাল প্যাকেজ ট্যুর আছে অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম সিয়াং জেলার সুন্দর উপত্যকা মেচুখায়। ওখানে গেলে দেখবেন অসাধারণ দৃশ্যপট আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মেম্বা জাতিগোষ্ঠীদের।

দু’রাত ওখানে থাকবেন, বেশ ভালোই লাগবে। কথাগুলো শুনে আমরাও ঠিক করলাম ওখানে যাওয়ার। গাইড রুম ছেড়ে যাওয়ার আগে আমাদের আরও জানালেন, আরও ১৮ জন ট্যুরিস্ট আছেন, তারা ওখানে যাচ্ছেন।

বমডিলা থেকে মেচুখায় যেতে প্রায় ১২/১৩ ঘণ্টা লেগে যাবে। আলং থেকে দুইশ’ কিলোমিটারের সামান্য বেশি দূরে সুন্দর উপত্যকা এই মেচুখা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৮ হাজার ফুট। ওখানে চারিদিকে পাহাড়বেষ্টিত উপত্যকার মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে ইয়ারগান নদী।

গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, মেচুখা শব্দের অর্থ কী? উনি একটু হেসে বললেন, ‘তুষারসৃষ্ট রোগহর জল’। ওই যে বললাম, ইয়ারগান নদীর কথা। ওই নদীর জলে স্নান করলে শরীরের রোগমুক্তিও এনে দেয়।

আর মনশা জাতির উপজাতি মেম্বাদের ওখানেও নিয়ে যাব। তাদের সঙ্গে খোলামেলা কথাও বলতে পারবেন। মেম্বারা সহজ-সরল, ওরা খুবই অতিথিবত্সল...।

ভোর ছ’টায় রওনা হলাম। রাত ১০টায় এসে পৌঁছলাম মেচুখাতে। যে ঘরে এলাম, দেখি এটি বাঁশ ও কাঠের গুঁড়ির মাচার ওপর পাতার ছাউনি দেয়া ঘর। ঘরের চারদিকে সুন্দর বেড়া। ঘুম ভাঙল বেশ ভোরে।

ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়লাম। সামনের কাঠের রেলিংয়ের ওপাশে টবে ফুলগাছটা এখনও মাথা নিচু করে ঘুমোচ্ছে। এখানে চারদিকেই পাহাড়। পর পর কয়েকটা ধাপ পেরোলেই বরফচূড়ার ঝলমলানি।

হালকা কুয়াশা আর মেঘের রেশ তখনও রয়েছে। স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। সূর্য তখনও ওঠেনি, অথচ জেগে উঠেছে উপত্যকা। পিঠে ঝুড়ি নিয়ে মানুষের আনাগোনা।

একটু পরে দেখি মেঘ-কুয়াশার মধ্য দিয়ে সূর্য খানিক বিচ্ছিন্নভাবে এদিক-সেদিক আলোয় ভাসিয়ে দেখা দিল। ওপারের বরফে কালো পাহাড় মেঘের আড়ালে চলে গেল, আর সেই সকালের আলোতে দেখা গেল সামনের টিলার ওপারের বৌদ্ধমন্দিরটা।

পাহাড়ের পাদদেশে একটা গাছের কাছে যেতেই কানে ভেসে এলো, ‘পথের পথিক যৌবন জয় রথে পথের পথিক বলে বারবার... চলে রাতের ও রজনীগন্ধা বাজে মন্দিরা চঞ্চল বায়’ গানের কথাগুলো। এগিয়ে গেলাম সেই যুবকটির কাছে।

পরিচয় দিতেই সে জানালো, আমি এসেছি কোচবিহার থেকে। নাম ‘রবীন’। বললাম, তুমি যে গানটি গাইলে, এ গানের শিল্পী কে? একটু হেসে বলল,আমার বাবার বড্ড প্রিয় এই গান। এই গানের শিল্পী ছিলেন রবীন মজুমদার। ‘কি যেন কহিতে চায় তোমারে এ দুটি আঁখি...’ গানের ভাষায় এ কথাগুলো শুনিয়ে রবীন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ভাবলাম, বাঙালি আমরা, কতই না আমাদের মধ্যে মিল।

একটু এগিয়ে দেখি কয়েকটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে মুরগির মাংস। আর রয়েছে মাছ—বরফের রুই, তার পাশেই শোয়ানো আছে কুড়াল, যা দিয়ে তা কেটে বিক্রি হবে।

আর একটু এগোতেই একটি বড়, বেশ খরস্রোতা নালা পাওয়া গেল। ওপারে লোহার পুল। গাড়ি সহজেই পেরিয়ে আসছে এই পথে। আলাপ হলো গুজরাটের ছেলে কৃষ্ণনের সঙ্গে। সে এখানে একটা প্রজেক্টের দায়িত্বে রয়েছে। বেড়াতে এসেছি শুনে খানিক আশ্চর্য হলো, আবার খানিক খুশিও। হঠাৎ সে চলে গেল।

বিকালে এলাম মেম্বাদের এলাকায়। সেদিন ওই বাড়িতে চলছিল বিয়ের উত্সব। নানা খানাপিনায় অতিথিরা বেশ মশগুল। বহিরাগত আমাদের ১৮ জনকে নিয়ে তাদের কৌতূহল আর কৌতুকের অন্ত নেই।

আলাপ হলো অনেকের সঙ্গে। খানিক মিলেমিশে আনন্দ করলাম আমরাও। তারপর পর্যাপ্ত পানভোজন ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা গেস্টহাউসে ফেরার পথ ধরলাম। বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের খানিকটা তখনও বাকি।

গেস্টহাউসে ফিরে আসার পরেই শুরু হলো মুষল ধারায় বৃষ্টি। ঝড়ো হাওয়ায় কিছুটা ভয় পেলাম। ঘণ্টাখানেক পরে দেখি আবহাওয়া ঠিক হয়ে গেছে। এদিকে টানা অন্ধকারে থেকে চোখও সয়ে গেছে বেশ।

জানলা দিয়ে বাইরে চোখ যেতেই দেখি নিচের জনপদের ইতস্তত চিকমিকে আলো...। তখন মনটা উত্ফুল্ল হয়ে উঠল।

আবার ফিরে এলাম বমডিলায়। এবার পলাশ আর আমি ছুটলাম বমডিলা থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরের তাওয়াংয়ে। ভারতের সবচেয়ে সুন্দর শৈল শহরগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এটি জেলা শহর।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মন-পা উপজাতীয়দের বসবাসই এখানে বেশি। এরা অত্যন্ত ধর্মভীরু, কর্মঠ এবং অতিথিবত্সল। ১০ হাজার ২০০ ফুট উঁচু এই তাওয়াংয়ে গিয়ে দেখলাম, চারশ’ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধমঠ। ওখানে গিয়ে শুনলাম, এখানে প্রায় পাঁচশ’ লামা স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ঢুকে বুদ্ধমূর্তিটিও দেখে নিলাম।

সংগ্রহশালায় রয়েছে প্রাচীন পুঁথি, কয়েকশ’ বছরের পুরনো বাসনপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, তালাচাবি, কাঠের মুখোশ, পুজোর উপকরণ, বাদ্যযন্ত্র, ধাতুনির্মিত মূর্তি ইত্যাদি। তাওয়াংয়ে উঠেছিলাম মনইয়ুনা লজে।

তাওয়াং দেখে এলাম দিরাংয়ে। ছোট্ট পাহাড়ি শহর দিরাং থেকে বমডিলার দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। এখানে গিয়ে উঠলাম নালক্ষ্মী লজে। দিরাং শহরের উচ্চতা ৫ হাজার ৫০০ ফুট। এ শহরে গিয়ে মনে হলো, এ জনপদটির শোভা কতই না মনোমুগ্ধকর।

প্রাকৃতিক শোভা দেখে দেখে এলাম আপেল ও নাশপাতির বাগানে। দু’নয়ন ভরে দেখেই যাচ্ছি। সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম লজে। পলাশ বললো, কালকেই রওনা দিতে হবে গৌহাটির দিকে।

জানলার বাইরে চোখ যেতেই দেখি চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ভাবলাম, পাহাড়ি পথ ধরে ফিরে যাবো বমডিলা হয়ে তেজপুরে। তারপর গৌহাটিতে এসে দু-চারদিন থাকার পর রওনা হব ফেরার পথে।

তবুও স্মৃতিতে যে জ্বলজ্বল করবে অরুণাচলের অপরূপ পাহাড়ি শোভা, তখন কি মনে পড়বে না, ‘ঐ পাহাড় ঝরনা আমি চিতা বাঘ মিতা আমার গোখুরো খেলার সাথি... আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই...’ গানের এ কথাগুলো!!
 
বাংলাদেশ সময় : ২০৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।