ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

কুং ফু একটি শিল্প: ইপ মান

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৫২, মার্চ ৩০, ২০১৩
কুং ফু একটি শিল্প: ইপ মান

মাস্টার লিয়ান শুন কুং ফু ক্লাস নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা মন দিয়ে ক্লাস করছে।

লিয়ান যখন ক্লাস নেয় তখন সে ঘোরের মধ্যে থাকে। কেউ বিরক্ত করলে তাকে ছাড় দেওয়া হয় না। ক্লাসে কারও অমনোযোগী হওয়ার সুযোগ নেই।

ক্লাসে শেখানো হচ্ছে কিভাবে সাইড কিক দিতে হয়, শত্রুর আক্রমণ কিভাবে রুখে দিতে হয় এবং পাল্টা ঘুষি কি করে দিতে হয়। যখন অত্যন্ত চমৎকারভাবে এ শিল্পকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে মাস্টার লিয়ান। ঠিক সে মুহূর্তে অন্য কক্ষ থেকে এক বৃদ্ধ হেসেই চলছে।

বৃদ্ধের এ হাসি লিয়ানে পছন্দ হয়নি। সে ক্লাস বন্ধ করে চিৎকার করে ওঠে। ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে লিয়ান বলে, এই বুড়া লোক। তুমি হাসছো কেন?

বৃদ্ধ লোকটি বিব্রত হলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, দুঃখিত। তোমরা ক্লাস চালু রাখো। তোমাদের আর বিরক্ত করবো না।

কিন্তু এতে লিয়ানের রাগ কমেনি। সে বলে, দেখ বুড়া। কয়েক মাস আগে আমরা তোমাকে একটা গারবেজে পেয়েছি। অসহায় অবস্থা থেকে এখানে তোমাকে আনা হয়েছে। বিনা পয়সায় তোমার খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের প্রতি তোমার কোনো সম্মানবোধ নেই? অভদ্র।

এবার আর বৃদ্ধ চুপ করে থাকলেন না। তিনিও রেগে গেলেন। জবাবে তিনি বললেন, তোমরা যদি শিল্পকে সম্মান না দেখাও তবে তোমরা সম্মান পাবে সেটা কিভাবে আশা করো।

লিয়ান বলল, আমরা সম্মান দেখাচ্ছি না মানে? কি বলতে চাও তুমি?

বৃদ্ধ বলল, হ্যাঁ। তোমরা বাতাসে ঘুষি দিয়ে চর্চা করছো। এটা তো হাস্যকর। তুমি বাতাসকে মারছো। কিন্তু বাতাস তোমাকে মারছে না। তার কোনো কৌশল নেই। সব কৌশল তোমার। কিন্তু যখন শত্রু তোমার সামনে আসবে তখন সে বাতাস হবে না। জ্যান্ত মানুষ হবে। তার হাজারো কৌশল থাকবে। তোমার ছাত্ররা বোকার মতো শত্রুর কাছে হেরে যাবে।

এতো কিছুর পরও লিয়ান শান্ত হবার নয়। সে বলেই বসলো, ঠিকাছে। যদি তুমি এতই পারদর্শী হও তবে আমাদের শেখাও। দূর থেকে দেখে হেসে লাভ নেই।

বৃদ্ধের কাছে এটা ছিল চ্যালেঞ্জ। লিয়ানের চ্যালেঞ্জের দিনটি ছিল ১৯৫২ সালে। বৃদ্ধের নাম ইপ মান। তার কাছে কুং ফু একটি শিল্প। এ শিল্পকে সে মনে প্রাণে ভালোবাসে। এ শিল্পকে ঘিরেই এক সময় সে ধ্যান করেছে। লিয়ানের চ্যালেঞ্জ নিতে পবিত্র শিল্পের মনে ইপের এক সেকেন্ডও দেরি হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে লিয়ানের সঙ্গে তার কুং ফু শুরু।

লিয়ান কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাবু হয়ে পড়লো। সে আত্মসমর্পণ করলো। ভরা মজলিসে শত শিক্ষার্থীর সামনে লিয়ান বৃদ্ধ ইপ মানের কাছে নতি স্বীকার করে তার ছাত্র হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। এ লিয়ানকে বলা হয় ইপ মানের প্রথম অনুসারী।

ইপ মানের জীবন
ইপ মানের জন্ম চীনে। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই স্বচ্ছলভাবে বেড়ে ওঠা ইপ দারিদ্র্যতা দেখেনি। পারিবারিক ব্যবসা করেই বেশ যাচ্ছিল ইপ মানদের। মা বাবার অত্যন্ত আদরের ইপ সারাদিন ঘুরে বেড়াতো শহরের অলিগলি। তার বেশ আগ্রহ ছিল নিজেদের প্রসাদসম ঘরের পেছনের দিকে। সেখানে থাকতো চান ওয়া শুন।

চান ওয়া শুন হলো চিনের অত্যন্ত নামকরা একজন কুং ফু শিক্ষক। বলা হয়, ইপ ছিল তার শেষ ছাত্র।

চান ওয়া শুন তাদের ব্যবসার অনেককেই ‍কুং ফু প্রশিক্ষণ দিত। তার এ স্টাইলের নাম ছিল ‘উইং চুন’। ব্যবসায় কাজ করা শ্রমিকদেরই বেশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এর কারণও ছিল। চোর ডাকাত দলের সঙ্গে লড়াই করার জন্যই  ইপ পরিবারের পক্ষ থেকেই এ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এমনকি ইপ পরিবারের জন্য নিযুক্ত বিশেষ রক্ষীদেরও ‘উইং চুন’ প্রশিক্ষণ নিতে হতো।  

এদিকে ইপ মানকে যেতে হতো স্কুলে। যেখানে তার একদমই ভালো লাগতো না। তার ভাষায়, জোর করে কবিতা মুখস্থ করা, মুখস্থ লেখা এগুলো কোনো শিক্ষা না।  

এ নিয়ে মানসিকভাবেই বিপাকে পড়েন ইপ। তারপরও নয় বছর পর্যন্ত স্কুলে গেছেন। এরপর তিনি একদিন চান ওয়া শুনের কাছে হাজির হলেন। তার ছাত্র হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বসেন।

চান শুরুতে ইপের অনুরোধ এতোটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। চানের বয়স তখন ৬০ বছর। চানের অধিকাংশ ছাত্র তখন ৩০ বছরের উর্ধ্বে। সে সময় সম্ভ্রান্ত পরিবারের অনেকেই চাইতো না তাদের সন্তান কুং ফু’র প্রতি আকৃষ্ট হোক। এসব নিয়ে চান খুব বিব্রত ছিলেন। তিনিও চাইতেন না যে ইপ কুং ফু শিখুক। এজন্যই সে ইপকে বলল, ঠিকাছে আমি তোমাকে শেখাবো। তবে এজন্য তোমাকে বেতন দিতে হবে। তিনটি সিলভার খন্ড দিতে হবে।

চান ওয়া ভেবেছিলেন এ বাচ্চা ইপ এতো সিলভার কোথায় পাবে। কিন্তু ধারণাটি ভুল ছিল। সে পরের দিনই ৩০০ সিলভার খণ্ড নিয়ে হাজির হয়ে গেল। সেসময় এর সমপরিমাণ মূল্য দিয়ে একটি বাড়ি কেনা যেত। চান ওয়া ভাবলো এই ছেলে বোধ হয় ঘর থেকে চুরি করেছে। সে তখন ইপকে নিয়েই তার বাবা মা’র কাছে যায়। ইপের বাবা মা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, ইপ অনেক আগেই থেকেই সিলভার জমাতো। এখন পর্যন্ত সে ৩০০ সিলভার জমিয়েছে। তার জমানো সব সিলভার নিয়ে সে হাজির হয়েছিল চান ওয়ার সামনে।

ছেলের আগ্রহ তীব্র বুঝতে পেরে বাবা মা রাজি হলেন। আর ইপ তখন চান ওয়ার ছাত্রদের খাতায় নাম লেখানোর সুযোগ পেলেন। এটি একটি ইতিহাস ছিল। কারণ ইপ ছিল আগের ২০০ বছরের প্রথম ছাত্র যার বয়স অত্যন্ত কম। বিপ্লবী উইং চুন স্টাইলের সর্বশেষ ছাত্র হিসেবেও ইপের নাম লেখা হলো। সেটা ছিল ১৯০৬ সালের ঘটনা।

জীবনের দ্বিতীয় ধাপ:
বৃদ্ধ চান ওয়া শুন ১৯১১ সালে মারা যান। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুতে কিছুটা ভেঙে পড়েন ইপ। তিনি চলে যান হংকং। সেখানে সেন্ট স্টিফেনস কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। হংকংয়ে পরিচয় হয় লিয়ান বাইকের সঙ্গে। তার ছেলে লিয়ান জান। সেও উইং চুন স্টাইলে প্রশিক্ষিত। তবে ভিন্ন আঙ্গীকে। ইপ পরিচিত হলো উইং চুন স্টাইলের ভিন্ন ধারার সঙ্গে। খুব আগ্রহ নিয়েই লিয়ান জানের কাছ থেকে তালিম নিত। তার সঙ্গে লড়তো। এতে করে সরাসরি কুং ফুর সঙ্গে মিশে যাওয়া যেত।

দীর্ঘ সময় পর ইপ ফিরে আসেন চীনে। তখন ইপ ‘উইং চুন’ স্টাইলের অন্যতম ধারক ও বাহক। সে সময় তিনি চীনের আর্মিতে কিছুদিন কাজ করেন। অনেক বছর তিনি কাউকে প্রশিক্ষণ দেয়নি। ১৯৪২ সালের দিকে জাপানিরা তাদের শহর দখল করে নেয়। সেটা ছিল কঠিন সময়। ইপের সব সম্পত্তি জাপানিরা দখল করে। অনেক সম্পত্তি নষ্ট করে দেয়। ইপ হয়ে পড়ে অসহায়। অর্থিক কষ্টতেও ভোগা শুরু করেন।

কয়েক বছর পর ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কমিউনিস্টরা তাকে পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব দিয়ে বসে। এ জীবনটা ইপ মোটেও উপভোগ করছিল না। এদিকে পুলিশের কুং ফু শিক্ষকও করে দেওয়া হলো। কিন্তু ইপের কাছে কুং ফু একটি শিল্প। সে এটিকে দিয়ে মানুষকে দমানোর কাজ করত চায় না। সে শিক্ষক হতেও চায়নি। এ শিল্পকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু এভাবে নয়। খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রমাণ করলো যে শিক্ষক হিসেবে ইপ মোটেও যোগ্য নয়। তার চাকরি গেল। আবার আর্থিক সমস্যায় পড়ে গেলেন ইপ।

তারপরের গল্পটা তো শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছে। অভাবে পড়ে ছিল। সেখান থেকে অসুস্থ ইপকে তুলে নিয়ে আসলো কুং ফু স্কুলের শিক্ষক লিয়ান। সেখানেই বলতে গেলে প্রথমবারের মতো মন থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলো ইপ মান।

ধীরে ধীরে ছাত্র বাড়তে থাকে। ছোট্ট স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বাইরে চলে আসে। সেখান থেকে ছাত্রদের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে স্কুল। প্রথমবারের মতো ‘উইং চুন’ স্টাইল পেল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। কিন্তু মজার বিষয় ছিল, ইপ কখনও সামনে থেকে কাউকে প্রশিক্ষণ দেননি। তিনি ভেতরের পর্দার আড়ালে থাকতেন। তাকে শুধু দেখতে পেতো সামনের সারিতে থাকা যে কোনো একজন প্রিয় ছাত্র। সে ছাত্রকে অনুসরণ করতো বাকি সবাই।

এমন অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা তার অনেক ছাত্ররা দিয়েছে। অনেকে বলেছে, ইপকে অনেকেই বুড়া বলে কৌতুক করতো। এজন্যই সে সামনে আসতে বিব্রতবোধ করতো।

ইপের ছাত্রদের অন্যতম ছিল হলিউডের এক সময়ের সুপার স্টার ব্রুস লি। ইপের প্রিয় ছাত্র ব্রুস লি একবার বলেছিল, ইপ অসাধারণ মানুষ। কুং ফু সম্পর্কে তিনি একদিন আমাকে  বলেছিলেন, বিশ্রাম ও শান্ত মনের অধিকারি হও। যখন লড়াই করবে তখন নিজেকে ভুলে যাও। তোমার মন ও আত্মা নিয়ে সওয়ার হও শত্রুর উপর। দেখবে শুধুই তার দেহের নড়াচড়া নয়, তার মনের গতিও তুমি ধরতে পারবে। শত্রুর মনের গতি ধরতে পারটাই হলো কুং ফু শিল্প।

ব্রুসলি ইপকে অধ্যাপক বলে ডাকতেন। তার কাছে ইপ হলো কুং ফুর অধ্যাপক। এমন মানুষ বিশ্বজগতে বড় প্রয়োজনীয়।

বয়স যত বাড়ছিল ইপ ততই রহস্যময় হয়ে উঠছিলেন। মানুষ তার দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়া শুরু করে। একসময় স্কুলের ভাড়া পরিশোধ না করায় বিবাদেরও সৃষ্টি হয়। কিন্তু ছাত্রদের চেষ্টায় সেসব ঝামেলা মিটে যেত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে একাকিত্বের ফাঁদে ফেলে দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। অনেকে বলেন, প্রথম স্ত্রী হারানোর বেদনা তাকে ছাড়েনি। এজন্যই এতো হতাশা।

ইপ মান প্রথম বলেছিলেন, উইং চুন বিক্রি হবে না। এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। যারা কুং ফুকে ভালোবাসবে এবং ভালো কাজের জন্য ব্যবহার করবে তাদের জন্য এই স্টাইল উৎসর্গ করা হলো।

রহস্যময় এবং বিশ্ব কুং ফুর এ ধ্যানী শিল্পীর মৃত্যু ঘটে ১৯৭২ সালের ২ ডিসেম্বর। তার আগেই ১৯৭০ সালে তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। বলেন, অনেক হয়েছে। এবার তোমাদের দায়িত্ব।

বিদায় হয়ে যাওয়ার পর বিশ্ব কুং ফু প্রেমিরা আজও তাকে মনে করে। ইপ একবার বলেছিলেন, মানুষ কখনও অনুভব করে না- তাদের জীবন বদলে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষের জীবন ক্রমাগত বদলায়। কখনও এটি সামনে যায়। কখনও এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে চলে যায়। এ বদলের প্রক্রিয়াটি যখন শুরু হয় তখন জীবন তোমাকে সময় দেয় অতীত ভুলে যাওয়ার। যারা ভুলে যায় তারা জয়ী হয়। যারা অতীত মনে রাখে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।