ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ভালো নেই মুক্তিযোদ্ধা ননী

ডেস্ক রিপোর্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:২৫, মার্চ ৩০, ২০১৩
ভালো নেই মুক্তিযোদ্ধা ননী

কিশোরগঞ্জ:  মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হলেও জীবন যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে চলেছেন মু্ক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক ননী। জীবন সায়াহ্নে এসে সংগ্রাম করে চলেছেন তিনি।



বয়স, অসুখ-বিসুখ, পুষ্টিহীনতায় কাবু এ হতভাগ্য মুক্তিযোদ্ধার এক সময় সব ছিল। শক্তিহীন কঙ্কালসার পঙ্গু দেহটি ছাড়া এখন তার আর কিছুই নেই।

কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিম তারাপাশার ৭১২/২ নম্বর সরকারি পরিত্যক্ত বাসাটিতে তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন। এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর টর্চারক্যাম্প। দরজা-জানালাহীন ভাঙাচোরা একটি পাকা ভবন। জানালাগুলো কাপড় দিয়ে আটকানো। শেওলাপড়া দেওয়াল ও ছাদে অসংখ্য ফাটল। প্রায় প্রতিদিনই ভেঙে পড়ে বাড়ির কোনো না কোনো অংশ। সবগুলো কক্ষের ছাদ বাঁশ দিয়ে ঠেকা দেওয়া।

রাতে ঘরে সাপ-শেয়াল ও নিশাচর প্রাণীর নির্বিঘ্ন আনাগোনা। বর্ষাকালে পুরো ঘর পানিতে একাকার হয়ে যায়। মেঝেতে হাঁটু সমান পানি জমে যায়। প্রতি শীতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তাদের মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। স্যাঁতসেঁতে ভ্যাপসা অস্বাস্থ্যকর এ বাড়ির একটি কক্ষের শক্ত কাঠের বিছানায় এভাবেই চরম ঝুঁকি নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক ননী।

জানা গেছে, ২০০৬ সালে সরকার তাকে পাঁচ শতক ভূমির ওপর স্থাপিত ভবনে অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেয়। কিন্তু এখানেও স্বস্তিতে নেই তিনি। তার পঙ্গুত্বের সুযোগ নিয়ে সদর উপজেলার স্বল্পযশোদল গ্রামের আবদুল কুদ্দুস নামে এক সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা তাকে এ বাড়ি থেকে উচ্ছেদের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তার ইন্ধনে একটি চক্র বাড়ি ছেড়ে দেওয়াসহ প্রায় প্রতিদিনই নানা রকম ভয়ভীতি দিয়ে যাচ্ছে ননীর পরিবারকে।

মুক্তিযোদ্ধা ননী বাংলানিউজকে জানান, তারা হুমকি দিয়ে গেছে, এখন কিছু না করলেও তিনি মারা যাওযার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটি তারা দখল করে নেবে। এ ধরনের হুমকিতে তিনি মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে তার মৃত্যুর আগেই বাড়িটি স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন ননী। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৩০ জানুয়ারি ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা এ বাড়িটি ননীকে স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দিতে জেলা প্রশাসককে লিখিত নির্দেশ দেন।

কিন্তু আজ পর্যন্ত এ নির্দেশ কার্যকর হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, ননীর নামে বাড়িটি অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হলেও প্রশাসন এখন ওই বরাদ্দ বাতিল করে ননীসহ দুইজনকে বাড়িটি দিতে চাইছে।
একাত্তরে ননী কৃষি বিভাগে নিম্নমান সহকারী হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। ওই সময় গেরিলা বাহিনীতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

তৎকালীন ঢাকা মহানগরীর এফএফ বাহিনীর প্রধান সিটি কমান্ডার ও স্টুডেন্ট বাহিনীর প্রধান আবদুল আজিজ বীর প্রতীকের অধীনে ঢাকার ২নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন তিনি।

ননী জানান, আগস্ট মাসের শুরুর দিকে এক প্লাটুন পাকিস্তানি আর্মি নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা ডিনামাইট দিয়ে আক্রমণ চালায়। এতে পাকিস্তানি আর্মির মেজরসহ ওই প্লাটুনের সব আর্মি মারা যান। ১১ আগস্ট কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনিও গ্রেফতার হন। এরপর পাকিস্তানি ক্যাম্পে চলে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন। যার নির্মম চিহ্ন তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন আজও।

নির্যাতনে তার বা পা ও কোমরের হাড় ভেঙে যায়। গ্রেফতার হওয়া অনেককে মেরে ফেলা হলেও তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।

১৯৭৩ সালে তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। পরে কৃষিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদের সহযোগী হিসেবে বিশ্ব খাদ্যসংস্থার কার্যক্রমে ৭ বছর ইতালির রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা তাকে দেওয়া হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা ননী আরও জানান, তার বিরুদ্ধে একটি চক্র ষড়যন্ত্র শুরু করার পর থেকে প্রশাসন থেকেও তাকে অবহেলা ও উপেক্ষা করা হচ্ছে, বিজয় দিবস-স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে আগে তাকে দাওয়াত দেওয়া হতো। এখন তিনি আর দাওয়াত পান না। তার শেষ প্রত্যাশা-একটি স্থায়ী ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে তার অবর্তমানেও যেন পরিবারটি কোনো রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে।

ননীর স্ত্রী মঞ্জিলা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, তিনি পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গু হয়েছেন। অথচ তাকে যুদ্ধাহতের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এ স্বীকৃতিটুকু পেলে পরিবারটি বেঁচে যেত। পেনশন ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা দিয়ে যে আর চলছে না তাদের। বাড়িটি বরাদ্দ পেলে তাদের একটি স্থায়ী ঠিকানা হতো। বাড়ি বেদখল যাবে এমন ভয়ে তার স্বামী চিকিৎসার জন্যও ঘরের বাইরে যেতে চান না। এ কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্তান নিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে জরাজীর্ণ বাড়িটিতে বসবাস করছেন তিনি।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. সিদ্দিকুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ননীসহ দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে এ বাড়িটি দিতে চেয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় তা ঝুলে আছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০১ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৩
সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।