ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘দুইডা টাহা দে না, বাসা ভাড়া দিবাম’

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:০১, এপ্রিল ২, ২০১৩
‘দুইডা টাহা দে না, বাসা ভাড়া দিবাম’

ঢাকা: ‘‘বাপজান দুইডা টাহা দে না, বাসা ভাড়া দিবাম। মাস শ্যাষ, বাসা ভাড়া দেওয়া অয় নাই।

একটু দয়া করো বাজান। ’’

মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর মালিবাগ সুপার মার্কেটের সামনে এভাবেই করুণ সুরে ভিক্ষা চাইছিলেন জহুরন নেছা (৯০)। দুই হাতে দু’টি লাঠি দিয়েও শরীর সামলাতে পারছিলেন না। থরথর করে কাঁপছিলেন।

রাস্তাঘাটে ভিক্ষুকের দেখা হরহামেশাই মেলে। তবে এভাবে বাসা ভাড়ার কথা বলে ভিক্ষা চাওয়ার বিরল চিত্র দেখে মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে অনেকেরই।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জহুরন নেছা বলেন, “বাজান আমার দুনিয়াতে দেখার মতো কেউ নেই। একজন ভাই আছিল, হেয়ও মইরা গেছে। ১৬ বছর ধইরা ঢাকায় থাকি। আগে বাসা ভাড়া আছিল ৬০০ টাহা। এই মাস থেকে ৮শ’ টাহা দিতে বলেছে বাসার মালিক। আগেই কষ্ট হইতো। এহন বাড়তি টাকা জোগাড় করা নিয়া চিন্তায় আছি। ”

শরীর তার ভিক্ষা করতে সায় দেয় না। কিন্তু পেটের জন্য রাস্তায় নামতে হয়। দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি ভিক্ষা করতে পারেন না। বের হন সকাল ৯টার দিকে বস্তিতে ফিরে যান ১২টার দিকে। কোনোদিন ৫০ টাকা, কোনোদিন ১শ’ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এই দিয়ে দিন কাটছে তার। তবে মাসের শেষ দিনগুলো এলেই তার চিন্তার অন্ত থাকে না। কারণ এ সময়টাতে বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে হয়।

খুব পরিষ্কার করে তার ঠিকানাটাও বলতে পারছিলেন না। কোনোমতে বলেন, ‘‘কমলাপুর হেই দিক দিয়া রেল যায়, হের পাশ দিয়ে বাস যায় না? সেহানে থাহি। তয় আমারে এই হানে আইলেই পাইবেন। ’’

নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার পানর গ্রামের ছিল জহুরন নেছার সংসার। স্বামী মারা যান স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ বছর পর। সেখানে থাকতেন অন্যের জমিতে। ওই জমির মালিক জমি ছেড়ে দিতে বললে, ১৬ বছর আগে ঢাকায় চলে আসেন।

শরীর যখন চলতো, তখন বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজ করতেন। অনেক দিন ধরেই আর শরীর সায় দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে ভিক্ষুকের খাতায় নাম লেখান। একদিন ভিক্ষা করার সময় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে গেছে। সেই থেকে দুনিয়ার কষ্ট যেন তার মাথায় ভর করেছে।

মাস চলতে কি পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা জানালেন, “দুই হাজার টেহা হইলেই আমার চলতো। পামু কই? কে দেবে আমারে? আমার যে আর শরীল চলে না বাজান। ”

শেষ ইচ্ছা কিছু টাকা সংগ্রহ হলে কাফনের কাপড় কিনে রাখতে চান। যাতে মরার পর আর তাকে পড়ে থাকতে না হয়। বা কারও সাহায্যর প্রয়োজন না পড়ে। ভিক্ষা পেশাকে ঘৃণা করেন। কিন্তু নিরুপায় হয়ে এ পথে নেমেছেন।

প্রতিদিন ভিক্ষা করতে বের হন না। সপ্তাহে ৩/৪ দিন বের হন। থাকেন মালিবাগ সুপার মার্কেটের দক্ষিণ গেটের সামনে (চিশতিয়া ক্রোকারিজ)। একই বস্তিতে কিছু গার্মেন্টসের মেয়ে থাকেন। তারাই তার জন্য খাবার তৈরি করে দেন বলেও জানান তিনি।
 
এই বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলার সময় বেশ কয়েকজন কৌতুহলী পথচারী কান পেতে শুনতে থাকেন।

ঘটনা জেনে তারা মন্তব্য করেন, “ভিক্ষুকের ঝোলায়ও বাসার মালিকের থাবা। রেহাই পাচ্ছেন না কেউই। মাস শেষে বেতন বা আয়ের বেশিরভাগ অংশ তুলে দিয়ে খেয়ে না খেয়ে মাস কাটাতে হচ্ছে। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৩
ইএস/ সম্পাদনা: আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর ও অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- eic@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।