ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ: বাঙালি জাতির এক অধ্যায়ের সমাপ্তি

আদিত্য আরাফাত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৪৮, এপ্রিল ১১, ২০১৩
বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ: বাঙালি জাতির এক অধ্যায়ের সমাপ্তি

ঢাকা: বিনোদ বিহারী চৌধুরী। একটি ইতিহাস।

যে ইতিহাস বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়।

বুধবার রাত ১০টা ১০মিনিটে কলকাতার একটি হাসপাতালে তাঁর শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। মহাপ্রয়াণে গেলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাস্টার দা সূর্য সেনের এ সহযোদ্ধা।

তিনি ছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সর্বশেষ বিপ্লবী। নতুন প্রজন্মের অহংকার ছিলেন বিনোদ বিহারী।

বয়সের ভারে ন্যুজ হলেও রাজনীতিতে অবক্ষয় ঘটলেও আশাবাদী থাকতে চান নতুন প্রজন্মের ওপর। বিশ্বাস করেন সব কিছুরই একটা শেষ আছে, সুতরাং কোন একদিন ঘুরে দাঁড়াবে এদেশের মানুষ। জীবনের শতবর্ষ পেরিয়েছেন এরই মধ্যে। গত ১০ জানুয়ারি ১০৪ বছরে পদার্পণ করা এ বিপ্লবীর জীবনাবসান ঘটলো ১০ এপ্রিল। এর মধ্যে ইতি হলো ১০৪ বছরের একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের।

রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাই, দেশ ভাগ ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় পটপরিবর্তনসহ নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও দেশত্যাগের চিন্তা করেননি কখনও। মরতে চান প্রিয় জন্মভূমিতে। গত জন্মদিনে শুভানুধ্যায়ীদের এমন কথাই জানিয়েছেন। vinod-01

শতবর্ষেও তিনি চলেছেন এক টগবগে যুবকের মতোই। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে হারিয়েছেন। ছোট ছেলের স্ত্রীসহ পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যরা থাকেন কলকাতায়। চট্টগ্রাম নগরীর মোমিন রোডের সেই ছোট্ট বাড়িটিতে বৃদ্ধ বয়সে কাটিয়েছেন নিঃসঙ্গ জীবন।

অগ্নিযুগের এ বিপ্লবীর জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার উত্তরভূর্ষি গ্রামে। বাবা কামিনী কুমার চৌধুরী ছিলেন একজন আইনজীবী এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী। দুরন্ত কিশোর বয়সে বিনোদ বিহারী চৌধুরী যোগ দেন বিপ্লবী দলে। সংস্পর্শে আসেন মাস্টার দা সূর্য সেনের। দেশকে ইংরেজ শাসনের কবল থেকে উদ্ধারের মন্ত্রে উজ্জীবিত হন বিপ্লবী চেতনায়। ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধে সহযোদ্ধা হন মাস্টার দা সূর্য সেনের। এ যুদ্ধে তিনি আহতও হন, যা তিনি লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। কৈশোরের সেই যোদ্ধা পার করেছেন জীবনের ১০৪টি বছর।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং জেল জুলুম ও নির্যাতন ভোগের মাঝেও বিনোদ বিহারী চৌধুরী ছিলেন অদম্য। প্রতিকূলতার মাঝেও এগিয়েছে তাঁর শিক্ষাজীবন। ১৯২৯ সালে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে রায় বাহাদুর বৃত্তি লাভ করেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে কাটে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের একটি বড় অংশ।

তাঁর স্মৃতিকথায় বিনোদ বিহারী চৌধুরী জানিয়েছেন, মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন তৎকালীন বিপ্লবী দলে। আসেন মাস্টার দা সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও মধুসূদন দত্তসহ বিপ্লবীদের সংস্পর্শে। এরমধ্যে প্রথম তিনজনকেই শহীদ হতে হয় ফাঁসিতে ঝুলে। আর শেষোক্ত জন শহীদ হন ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা পুলিশের অস্ত্রাগার দখলে নেন। সে দলে ছিলেন বিনোদ বিহারী চৌধুরীও। অস্ত্রাগার দখল করে তারা ইউনিয়ন জ্যাকের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পতাকা উত্তোলন করেন।

পরিকল্পনামাফিক একই দিনে অন্য বিপ্লবীরা দখল করে নেন ফৌজি অস্ত্রাগার ও টেলিফোন ভবন। সেদিন উৎপাটিত হয় ধুম ও লাঙ্গলকোট রেলস্টেশন সংলগ্ন রেল লাইন। বিপ্লবীরা ১৮ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত চার দিনের জন্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন রাখেন। এ চারদিন ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ হয় জালালাবাদ পাহাড়ে। এ যুদ্ধ ইতিহাসে জালালাবাদ যুদ্ধ নামে পরিচিত। vinod-bg

অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ঘটনার পর বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীকে ধরতে হন্যে হয়ে খোঁজে তৎকালীন পুলিশ। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। এরপর ১৯৩৩ সালে তিনি গ্রেফতার হন। জেল খাটেন একটানা ৫ বছর। ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংশন পেয়ে তিনি বিএ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৮ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর আবার গৃহবন্দী হন। বন্দী থাকাকালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরেজী শাস্ত্রে এমএ এবং বিএল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী বিনোদ বিহারী চৌধুরী ১৯৩৯ সালের শেষদিকে ‘দৈনিক পাঞ্চজন্য’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। এর পাশাপাশি ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে যোগ দেন আইনজীবী হিসেবে। এ সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহসম্পাদক হন। ১৯৪১ সাল থেকে আবারও জেলজীবন। চট্টগ্রাম কারাগার, ঢাকা কারাগার ও বকসা বন্দী শিবিরে কেটে যায় ৫ বছর। বেরিয়ে আসেন ১৯৪৫ সালের দিকে। এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন।

ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান সৃষ্টির পর অনেকে দেশান্তরী হলেও জন্মভূমি চট্টগ্রামে থেকে যান বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখায় তাঁকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয় পাকিস্তান আমলেও। সর্বশেষ কারাবরণ করেন ১৯৬৫ সালে। তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে। ২০০০ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের সম্মাননা পেয়েছেন এ বিপ্লবী।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৩
এডিএ/সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।