এ পৃথিবীর সভ্য হতে সময় লেগেছে শত বছর। আর এ সভ্য হওয়ার পেছনে যুগে যুগে কাজ করে গেছেন আমাদের মতই মানুষ।
উইলিয়াম উইলবারফোর্স রাজনীতিবিদ। তবে তার পরিচয় সামাজিক আন্দোলনের জন্যই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। এক সময় এ পৃথিবীতে মানুষ কেনাবেচা হতো। সেসময় এ জঘন্য কাজটির বিরুদ্ধে একাই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন উইলিয়াম। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একটি দাবি নিয়েই বারবার সংসদে কথা বলেছেন। এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটেন বাধ্য হয় দাস বিক্রি অবৈধ ঘোষণা করতে।
শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলোর জন্য সোচ্চার হওয়া মানুষটির জীবন নিয়েই স্বপ্নযাত্রার এ প্রতিবেদন।
উইলিয়াম উইলবারফোর্সের জন্ম ২৪ আগস্ট ১৭৫৯ সালে। মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল পরিবারেই তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি ছিল তীব্র আগ্রহ। মেধার জোরেই বিশ্বখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে পরিচয় হয় উইলিয়াম পিট নামে প্রতিভাবান তরুণের সঙ্গে। বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে এই প্রতিভাবান তরুণ ব্রিটেনের সর্বকালের কনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
যাইহোক। ফিরে আসি উইলিয়াম উইলবারফোর্সের জীবনে। উইলিয়ামের পরিবার ছিল প্রগতিশীল। তবে মা চাইতেন উইলিয়াম ধর্ম শিক্ষায় মনোনিবেশ করুক। কিন্তু তিনি ভাবেন সমাজ নিয়ে। সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে। আর এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।
তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে মদ্য পানের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করে সবার নজরে আসেন উইলিয়াম। ছাত্র হিসেবে খুব একটা নাম না কামালেও ছাত্র সংগঠক হিসেবে তার যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা ছিল। তিনি অসম্ভব ভালো বক্তা ছিলেন। কোনো বৈঠকে বক্তব্য দিতে গেলেই উইলিয়ামের কণ্ঠে মুগ্ধ হতেন শ্রোতারা।
এসময় পড়ার ফাঁকেই জানতে পারেন ব্রিটেনে সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উড়ে যান পিতৃভূমি হালে। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে ৮ হাজার পাউন্ড খরচ করে পিতৃভূমি হালের সংসদ নির্বাচন করে জয়ী হন উইলিয়াম।
দীর্ঘ ৪ বছর সাংসদ থাকাকালীন সময়ে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ান। অন্যান্য দেশগুলো কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেসব বিষয়ে জ্ঞান নেওয়ার চেষ্টা করতেন। ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গী হিসেবে ছিলেন তার মা ও বোন।
মূলত এ সময়টিতেই তিনি মায়ের সঙ্গ বেশি পান। ছেলেকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে হয়ে গেল রাজনীতিবিদ। এ নিয়ে উইলিয়ামের মা’র কোনো কষ্ট ছিল না। তবে ছেলের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে সফল হয়েছিলেন।
ভ্রমণের সময় মা তাকে ধর্মীয় বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন। উইলিয়াম বই পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় নত হয়ে পড়েন। তিনি প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। উঠেই বাইবেল পাঠ করতেন। তিনি কখনও মদ্যপান করেননি। এমনকি জুয়ার মতো কোনো খেলাতেও অংশ নেয়নি। ধর্মীয় মতাদর্শ ধারা অনুযায়ীই চলা শুরু করেন উইলিয়াম।
১৭৮৬ সালে বন্ধু থমাস ক্লার্কসন উইলিয়ামকে ডেকে পাঠান দাসবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য। কোনো চিন্তা ছাড়াই এ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকেন উইলিয়াম। বন্ধু ক্লার্ক এবিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনার কথা বলেন। অর্থাৎ সংসদে ক্যাম্পেইনের প্রস্তাব দেন ক্লার্ক। এতে রাজিও হন উইলিয়াম।
মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে তোলপাড় শুরু হয় ‘দাসপ্রথা’ ইস্যূ নিয়ে। তাদের একটাই দাবি, মানুষ কেনাবেচা অবিলম্বে বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। এতে উইলিয়ামের সক্রিয় অংশগ্রহণ অনেক প্রবীন ও নবীন রাজনীতিবিদদের বিব্রত করে। তবুও সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল উইলিয়াম।
সর্বশেষ দাবি যুক্ত হয় উইলিয়ামের মাধ্যমেই। তিনি দাস বেচা বিক্রি নিষিদ্ধ করতে বিল পাশ করার প্রস্তাব দিয়ে বসেন।
হাউজ অব কমনস-এ দাঁড়িয়ে দৃঢ়চিত্তে উইলিয়াম বলে ওঠেন, ‘দাসপ্রথা একজন মানুষের জন্য চরম অপমানকর। একজন মানুষের আত্মসম্মানবোধকে এর চেয়ে নোংরাভাবে আঘাত করা সম্ভব নয়। এ জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় অবিলম্বে দাসপ্রথা বন্ধ করতে হবে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন একজন মানুষকে বিক্রি হতে দেখি তখন লজ্জায় আমি কুকড়ে যাই। আয়নায় আমি নিজেই নিজেকে দেখতে পারি না। গ্রেট ব্রিটেনের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এ ব্যবসা লজ্জাকর। এর জন্য আমরা সবাই দায়ী। ভবিষ্যতে এ ব্যবসার জন্য আমরা কোনোভাবেই অন্যকে দায়ী করতে পারবো না। এ জঘন্য কাজটির দায়ভার আমাদের কাঁধেই আসবে। এজন্যই এ প্রথা বন্ধ করে পাপমোচন করা উচিত। ’
তার বক্তব্যের পর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। সামাজিকভাবেই বয়কট হয় দাসবিক্রি। হাউজ অব কমনস বাধ্য হয় সংসদে বিল উত্থাপন করতে। অবশেষে ১৮০৭ সালে দাসবিক্রি অবৈধ ঘোষণা করে ব্রিটেন সরকার।
তবে পাশকৃত বিলটিতে দাসবিক্রি বন্ধ হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে বিক্রি হওয়া দাসদের মুক্তি মেলেনি। উইলিয়াম উইলবারফোর্স এবার এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন।
তিনি অফ্রিকায় গিয়ে এ আন্দোলন বিস্তার করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সামাজিকভাবে তিনি দাসদের মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করেন। অনেকেই তাদের কেনা দাসকে মুক্তি দিয়ে দেন। কিন্তু উইলিয়াম মুক্তির জন্য আরও একটি আইন চাচ্ছিলেন। এমনকি ভারত উপমহাদেশেও এ আন্দোলনের বীজ ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বব্যাপী শুরু হয় আন্দোলন। তবে উইলিয়াম বারবার বলছিলেন, ‘আমরাই যদি এর বিরুদ্ধে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, তবে আইন কিংবা বিল না করলেও চলবে। আমি চাই এ পৃথিবী সবার হোক। কেউ সেখানে দাস হবে না। আমরা সবাই মানুষ। সবাই এ সুন্দর পৃথিবীতে একসঙ্গে বাঁচবো। ’
অবশেষে ১৯৩৩ সালের ২৬ জুলাই অসুস্থ উইলিয়াম জানতে পারেন ব্রিটিশ সরকার সকল দাসদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আইন জারি করেছেন।
হয়ত এই দিনটি দেখার জন্যই জন্ম হয়েছিল উইলিয়ামের। কারণ এ সংবাদটি শোনার তিনদিনের মাথায় ১৯৩৩ সালের ২৯ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান উইলিয়াম।
আজও উইলিয়াম সংগ্রামী অসহায় মানুষের নেতা হয়ে আছেন। তাকে শ্রদ্ধায় স্বরণ করে বিশ্ববাসী। তার বক্তব্যের বিখ্যাত উক্তি আজও অনেকেই উল্লেখ করেন বিভিন্ন জায়গায়। তিনি একবার দাসবিক্রি নিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,
মানুষ হয়ে মানুষের কষ্টের সময় যদি আমি নিজেকে জীবন্ত বলে অনুভব করি তবে আমি উন্মাদ, পৃথিবীর আরোগ্যহীন উন্মাদদের অন্যতম।
এ বক্তব্য দিয়েই সংসদে অন্য সবার মনকে তীব্রভাবে ধাক্কা দিয়েছিলেন উইলিয়াম উইলবারফোর্স। যে ধাক্কাতেই উচ্ছেদ হয়েছে মানুষ বিক্রি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক