বিনোদনের খোরাক জোগাতেই টেলিভিশন দেখা। কিন্তু পছন্দের অনুষ্ঠানটি খুঁজে পাওয়া বর্তমান সময়ে মুশকিল হয়ে পড়েছে।
চ্যানেল বদলাতে গিয়ে চোখে যদি পড়ে টম অ্যান্ড জেরি? তখন বিষয়টা কি হবে? টম এবং জেরিকে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তা পৃথিবীর যে দেশের মানুষই হোক। এই দুটি চরিত্র দশকের পর দশক শিশু-কিশোর-তরুণ এমনকি বৃদ্ধদেরও বিনোদন জোগাচ্ছে। এখনও টিভির পর্দায় টমকে জেরির পেছন ছুটতে দেখে হেসে কুটি কুটি হয় দর্শক।
বিশ্ব মাতানো এ দুটি চরিত্র তো অ্যানিমেশন দিয়ে তৈরি করা। অ্যানিমেশনে আসার আগে এদের নিয়ে ভেবেছিলেন কারা? কিংবা কার হাত দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে ঐতিহাসিক টম এবং জেরি।
টম এবং জেরির সৃষ্টিকর্তা হলেন উইলিয়াম হ্যানা এবং জোসেফ বারবারা। পঞ্চাশের দশকে এ দুই বন্ধুর হাত দিয়েই আসে টম এবং জেরি। তার আগে থেকেই অবশ্য হ্যানা এবং বারবারার বন্ধুত্ব ছিল। তারা মিডিয়া জগতে চল্লিশের গোড়া থেকেই বিভিন্ন চরিত্র নির্মাণ করে আসছিলেন।
পেশায় উইলিয়াম হ্যানা একজন কমেডি লেখক। তার জন্ম ১৯১০ সালের ১৪ জুলাই। পড়াশোনায় কোনো আগ্রহ ছিল না উইলিয়াম হ্যানার। তিনি কলেজে ভর্তি হয়েও পড়া শেষ করেননি। তারপর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ছোট কাজ করতে করতে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। এমন সময়ে ১৯৩০ সালে হারম্যান অ্যান্ড আইসিং অ্যানিমেশন স্টুডিওতে কাজ পান। সেখানে বসেই কার্টুন বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয় উইলিয়ামের হ্যানার।
অন্যদিকে জোসেফ বারবারা হলেন কার্টুনিস্ট। তার জন্ম ১৯১১ সালের ২৪ মার্চ। জোসেফও ভাগ্যের তাড়নায় ছোটখাটো কাজ করে বেড়াতেন। তিনি ১৯৩৭ সালে মেট্রো গোল্ড ওয়াইন মায়ের (এমজিএম) স্টুডিওতে যোগ দেন।
হ্যানা-বারবারার দেখা হয় দেখা হয় ১৯৪০ সালে। দুজনই তখন এমজিএম স্টুডিও’র কার্টুন বিভাগে কাজ শুরু করেন। একসঙ্গে ১৯৪০ সালেই তৈরি করেন ‘পুস গেটস দ্য বুট’ কার্টুন।
উইলিয়াম-জোসেফের তৈরি ‘পুস গেটস দ্য বুট’ কার্টুনটি জনপ্রিয়তা পায়। এটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডেও মনোনীত হয়। কিন্তু জনপ্রিয় কার্টুন হওয়া সত্ত্বেও পুস গেটস দ্য বুটকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেসময় স্টুডিও’র প্রধান ছিল ফ্রেড কুইম্বি।
জনপ্রিয় হলেও লাভজনক কিছু আনতে পারছিল না কার্টুনটি। এজন্যই ফ্রেড আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলেন। কিন্তু ফ্রেডের কথায় খুব একটা পাত্তা দেয়নি দুই বন্ধু।
তারা তখন নতুন একটি আইডিয়া নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু সেটা ফ্রেডকে জানানো হয়নি। বিড়াল ও ইঁদুরকে নিয়ে একটি কার্টুন নির্মাণের কথা অবশেষে ফ্রেডকে জানায়।
ফ্রেড মনোযোগ দিয়ে আইডিয়াটি শুনেন। তারপর বলেন, ‘ঠিকাছে। যাও তোমাদের আইডিয়া নিলাম। ’
সেদিন হয়তো ফ্রেডও জানতো না আজ সেই বিড়াল-ইঁদুরের চরিত্র ‘টম অ্যান্ড জেরি’ ইতিহাস হয়ে যাবে।
এই দুটি চরিত্র সম্পর্কে উইলিয়াম হ্যানা বলেছিলেন, নিশ্চিতভাবেই জানতাম আমাদের দুটি চরিত্র প্রয়োজন। তাদের মধ্যে কনফ্লিক্ট হবে, তাদের মধ্যে মারামারি হবে। কিন্তু এক রহস্যময় মায়াও থাকবে দুজনের মধ্যে। আর সেটা আমরা বিড়াল ও ইঁদুরের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলাম।
প্রথম পর্ব প্রচারিত হয় ১৯৪১ সাল। এরপর টানা ১৭ বছর দাপট করেছে টম অ্যান্ড জেরি। হ্যানা এবং বারবারা্র হাত দিয়েই তৈরি হয়েছে ১১৪ টি জনপ্রিয় পর্ব। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও বিস্ময়করভাবে টম অ্যান্ড জেরি তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। তাদের দিয়েও যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখিয়ে কিছুটা বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছিল।
অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে নির্বাচিত হয়েও টম-জেরির সৃষ্টিকর্তাদের সন্ধান কেউ তখনও জানতে পারেনি। যেদিন অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হলো সেদিন মঞ্চে উঠে গেলেন ফ্রেড। কারণ তিনিই প্রতিষ্ঠানের প্রধান। এ পুরস্কার তিনিই নিয়ে আসলেন। কেউ জানতেই পারলো না উইলিয়াম হ্যানা এবং জোসেফ বারবারার কথা।
ফ্রেড ১৯৫৫ সালে অবসরে চলে যান। তারপর হ্যানা ও বারবারা এ স্টুডিও’র অ্যানিমেশন বিভাগের প্রধান নির্বাচিত হন। কিন্তু ফ্রেডের পর অন্য বিভাগগুলো ভেঙে পড়ছিল। টম অ্যান্ড জেরি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকলেও বাকি প্রজেক্টগুলোর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে অ্যানিমেশন বিভাগের উপর কিছু নিষেধাজ্ঞা এসে পড়লো।
প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হলো, টম অ্যান্ড জেরির পুরানো পর্বগুলোই দেখানো হবে। নতুন কোনো পর্ব দেখানোর প্রয়োজন নেই। এমন সমস্যায় অনেকটা ভেঙেই পড়েন দুই বন্ধু। ঠিক ওই সময়ে ১৯৫৭ সালে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়, এমজিএম স্টুডিও’র অ্যানিমেশন বিভাগ বন্ধ ঘোষণা করা হবে।
সেসময় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে টম অ্যান্ড জেরির ভাগ্য। তারা আর দর্শকদের সামনে আসবে কিনা তা নিয়েও দেখা দেয় সংশয়।
অন্যদিকে হ্যানা ও বারবারা দুজনেই টম এবং জেরিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চান। কিন্তু আর্থিক স্বচ্ছলতা ছাড়া সম্ভব নয়। তারপরও দুজনের মনোবল অত্যন্ত শক্ত। দুজনই জানতেন- তারা সমপরিমাণ যোগ্য।
তারা পরীক্ষামূলকভাবে ১৯৫৭ সালে অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে ফেলেন। নাম দেন ‘হ্যানা-বারবারা স্টুডিও’। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবারও ফিরে আসে টম অ্যান্ড জেরি। যাদের দেখে বিশ্ব আজও মুগ্ধ হয়। আজও ক্লান্তি ও গ্লানির জীবনে একটু মুঠো হাসি নিয়ে আসে টম অ্যান্ড জেরি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক