ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘যাসনে ভাই.... বাঁচা না হয় মেরে ফেল’

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও ওমর ফারুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:০৬, মে ১, ২০১৩
‘যাসনে ভাই.... বাঁচা না হয় মেরে ফেল’

সাভার থেকে: “ভাইরে, আমারে ছেড়ে যাসনে। হয় বাঁচা, না হয় ছুরি দিয়া জবাই করে মেরে ফেল।

আর সহ্য করতে পারছি না। ’ সাভারের রানা প্লাজায় চাপা পড়া শ্রমিকদের এমনই আর্তনাদ দেখেছে কিশোর উদ্ধার কর্মী সুমন মিয়া।

হালকা গড়নের এই কিশোর দ্বিতীয় দিন উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। স্বাস্থ্যবানরা যখন সরু সুড়ঙ্গ দিয়ে এগুতে পারছিলেন না, তখন জীবন বাজি রেখে এই কিশোর ভবনের অনেক ভেতর যেতে সক্ষম হয়। দেখতে পায় আটক পড়া শ্রমিকদের করুণ আর্তনাদ। সেসব আর্তনাদ শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি সে। ঘুরে এসে খবর দিয়েছে উদ্ধার কর্মীদের। তার দেওয়া তথ্য অনুসারে সুড়ঙ্গ করে অনেককে উদ্ধার করা হয়।

সুমন মিয়া থাকে ঢাকার খিলগাঁও এলাকায়। উদ্ধার কাজের দ্বিতীয় দিনে এক কাপড়ে চলে আসে সাভারে। প্রথমে উদ্ধার কাজে অংশ নিতে গেলে তাকে বাধা দেয় পুলিশ। পরে মাথায় সাদা কাপড় পেঁচিয়ে উদ্ধার কর্মীদের সঙ্গে মিশে ধসে যাওয়া রানা প্লাজার উপরে উঠে যায় সে।

এরপর আর বাসায় ফেরার কথা মনেও আসেনি তার। টানা কাজ করেছে উদ্ধার অভিযানে। ধসে যাওয়া রানা প্লাজার ভেতরের আটকে পড়াদের করুন আর্তনাদের কথা সে জানায় বাংলানিউজকে।

সুমন মিয়া বলে, “আমি যা দেখেছি, তা বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে এমন পরিণতি যেন আর কারও কপালে আল্লাহ না লেখে। ”

দ্বিতীয় দিন তখন সকাল ৯টা। ভেতর থেকে করুন আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু একটি পিলারের নিচ দিয়ে কেউ যেতে পারছিল না। প্রয়োজন ছিল হালকা-পাতলা গড়নের কাউকে। সেনাবাহিনীর এক অফিসার সুমনকে বলেন, ‘তুমি যেতে পারবা?’ সঙ্গে সঙ্গে সুমন বলে ওঠে, ‘অবশ্যই’।

যেই কথা সেই কাজ। সুমন ঢুকে পড়ে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে। কিছুদূর যাওয়ার পর মাত্র একফুটের মতো একটি গর্ত দেখতে পায় সে। অনেক কষ্টে সেখানে মাথা ঢোকায়। শরীর আর যেতে চাচ্ছিল না। কিন্তু ভেতর থেকে করুন আওয়াজ তার কানে আসে, ‘বাঁচাও, ও আল্লাহ বাঁচাও। ’ করুণ আর্তনাদ শুনে আর থেমে থাকেনি সে, জোর করেই ভেতরে গিয়েছে। এতে তার দুই কাঁধ ও কোমরের চামড়া ছিলে যায়।

ভেতরে গিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সুমন। দেখতে পায়, ছাদটি একেবারেই মেঝের সঙ্গে মিশে গেছে। চ্যাপ্টা হয়ে গেছে অনেকের শরীর। এক কোনায় বিম আড়াআড়ি পড়ে আছে, মেঝে থেকে ৩ ফুট ব্যবধানে ছাদ ঝুলে আছে। আর বিমের নিচে আটকে আছে কয়েকজন শ্রমিকের শরীর।

টর্চের আলো জ্বলে উঠতেই বিমের নিচে চাপা পড়ে থাকাদের মধ্যে দু’জন বলে ওঠেন, “কে ভাই, আমাকে বাঁচাও। ” আরও কিছুটা কাছে গেলে শোনা যায় আর্তনাদ, “ভাই বাঁচা, ছেড়ে যাসনে। হয় বাঁচা না হয় ছুরি দিয়ে মেরে ফেল, আর যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না। ”

কিন্তু এই দুই হতভাগাকে তুলে আনতে পারেনি সুমন। কারণ বিমটি সরানোর কোনো উপায় ছিল না। আর পা কেটে বের করলেও সুমন যে সুড়ঙ্গ দিয়ে গেছে, সে দিক দিয়ে তাদের আনা সম্ভব ছিল না। তারপরও সুমন আশা দিয়ে এসেছিল, “ভাই আমি আপনাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করবো। ধৈর্য্য হারাবেন না। ”

আটকে পড়ারা পানি খেতে চেয়েছিলেন। উপর থেকে পানি নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে সুমন। কিন্তু চতুর্থ দিনে গিয়ে সে দেখতে পায়, তারা মারা গেছে।

কিশোর সুমন মিয়া নিজ হাতে হ্যাকস দিয়ে একজনের হাতে কেটে তাকে উদ্ধার করে। হাত কাটার পর যখন ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছিল, সেই অবস্থায়ই এক হাত দিয়ে সুমনকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়েছিল উদ্ধার পাওয়া শ্রমিকটি। S-pic

সুমন জানায়, একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে গেলে সে দেখতে পায় সুতার রোলের উপর পড়ে আছে একটি বিম। কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সেখানে সে জোরে আওয়াজ দেয়, “ কে-উ কি আ-ছে-ন, আ-ম-রা উ-দ্ধা-র  ক-র-তে এ-সে-ছি। ” সঙ্গে সঙ্গে জবাব আসে, “বাঁচাও, বাঁচাও!” তার মানে সুতার রোলের বিপরীতে একজন আটকে আছে।

উঠে এসে একটি সুমন রশি নিয়ে আবার ভেতরে যায়। রশির একমাথা লাগায় সুতার রোলে। আর বাইরে থেকে অন্য উদ্ধার কর্মীরা টেনে একটু বাঁকা করেন সুতার রোলটি। সেখান থেকে একজন নারী শ্রমিককে উদ্ধার করে সুমন।

আরও বেশ কয়েকটি দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নেয় সে। চতুর্থ দিনে একটি সুড়ঙ্গের ভেতরে থাকা অবস্থায় উপরে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, “কে কোথায় আছো, দ্রুত বের হয়ে আসো। ” তখন ভয় পেয়ে যায় সুমন। ভেবেছিল হয়তো ভবনটি আবারও ধসে যাচ্ছে। দ্রুত উঠতে গিয়ে কনুই, কপাল ও হাঁটুতে আঘাত পায়।

ভবনটি ঝুলে আছে বলে অনেকেই যেখানে কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না, সেখানে ভেতরে যাওয়া দুঃসাহসিক কাজ। এতো সাহস কোথায় পেলো, এমন প্রশ্নের জবাবে সুমন বলে, “আমি নিজেও জানি না এই প্রশ্নের উত্তর। ”

বেশ কয়েক জনকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরে সে তৃপ্ত। তবে অনেকেই ছবি দেখিয়ে স্বজনের খোঁজ চেয়েছেন তার কাছে, কেউ আবার তাদের স্বজনদের উদ্ধার করে দিতে বলেছেন। কিন্তু সেটা করতে না পারেনি সুমন।

ক্রিকেট পাগল এই কিশোর ঢাকায় এসেছিল একটি ভালো ক্লাবে খেলতে। ইচ্ছে আছে জীবনে বড় ক্রিকেটার হওয়ার। ২০০৯ সালে অনুর্ধ্ব ১৫ দলের হয়ে ভারত খেলতে গিয়েছিল সে। বেস্ট ৫ উইকেট ভরেছিল তার ঝুলিতে। আর ২০১০ সালে ভারত অনুর্ধ্ব ১৭ দল বাংলাদেশ সফরে এলে সেবারও সুমন স্বাগতিক বাংলাদেশ টিমের হয়ে খেলেছিল।

বরগুনার বাবলা উপজেলার দুষখালি গ্রামে সুমনের বাড়ি। তার বাবার নাম সুলতান মিয়া। ৬ ভাইয়ের মধ্যে সে তৃতীয়। তার অপর দুই ভাই টমটম চালায়।

এসএসসি পাশের পর আর পড়া হয়নি তার। ক্রিকেটের নেশায় ঢাকায় এসেছিল, পরে খিলগাঁওয়ের একটি ছাত্রাবাসে উঠে। পুলিশ ক্রিকেট টিমে কথা হয়েছিল, তবে সেখান থেকে বলা হয়, ফ্রি খেলতে হবে। সুমন চেয়েছিল ঢাকায় যাতে খেয়েপরে থাকতে পারে এমন একটি ব্যবস্থা করতে, কিন্তু পুলিশ টিম ম্যানেজমেন্ট তাতে রাজি হয়নি।

আরও কাউকে যেন সাভার ট্র্যাজেডির মতো ঘটনায় প্রাণ হারাতে না হয়, এটাই এখন তার প্রার্থনা।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৯ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৩
ইএস/ ওএফ/ সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।