রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।
বান্দরবান থেকে ফিরে: বাঁশের পাশে বাঁশ জুড়ে প্রথমে একটি ভেলা। তারপর ভেলার মাথায় ভেলা জুড়ে ভেলার বহর। সাঙ্গুর বুকে যেন ভেলারই কাফেলা পাহাড়ের কোলে এঁকেবেঁকে আয়েসি ভঙ্গিতে ভেসে চলেছে উজান থেকে ভাটিতে।
দু’পাড়ে পাহাড়ি বসতি, নাম না জানা বৃক্ষের ঝোপ, পাহাড়ে পাহাড়ে জুমের ব্যস্ততা, নদীজলে ঘর-গৃহস্থালির নিত্য নড়াচড়া, খদ্দেরের অপেক্ষায় নিঃসঙ্গ দোকানী। মাথার ওপরে চেনা-অচেনা পাখির উড়াউড়ি। নিচে জলের ভেতর শামুক-ঝিনুক কুড়ানো আর মাছ ধরার জীবনঘনিষ্ঠ আয়োজন, বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে চলা বৈঠা বা ইঞ্জিন নৌকার দাপুটে ধাক্কায় অস্থির সাঙ্গুর জল। এরই মধ্যে ভেলার কাফেলায় দক্ষ মাঝির হাল।
উজানের বাঁশবন থেকে বাঁশ কেটে এভাবেই সাঙ্গুর বুকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ভাটির বাণিজ্য কেন্দ্রে। ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায় কখনো-সখনো। পাহাড়ি জীবনের পরতে পরতে তো বটেই, এই বাঁশ কাগজের মতো সভ্যতার বিভিন্ন উপরকরণ তৈরিরও প্রধান কাঁচামাল।
বাঁশ তাই পাহাড়ি অর্থনীতির অন্যতম উৎস। আর সাঙ্গু সেই উৎসের প্রধান চালিকা শক্তি।
এ নদীর পাথুরে বুকে সামুদ্রিক শামুক বা শঙ্খ কখনো ছিলো কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় কেউই। তবুও আবহমান কাল ধরে এ নামেই নদীটিকে চেনে দু’পাড়ের পাহাড়িরা। বৃটিশ প্রশাসনের কলমের খোঁচায় শঙ্খ বদলে সাঙ্গু নাম নেওয়া স্বচ্ছ জলধারার এ নদীকে অবশ্য রেগ্রীই খ্যং নামে ডাকেন স্থানীয় সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।
বাংলাদেশের নদীগুলো মূলত উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বিভাগের বৃহত্তম জলধারা সাঙ্গু দক্ষিণ থেকে প্রথমে গেছে উত্তরে, তারপর পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে এগিয়েছে বঙ্গোপসাগরের দিকে।
এই সীমান্ত নদীরই একটি অংশ অমায়ক্রি চং বা রেমাক্রি চং বা প্রধানমন্ত্রীর খাল। মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষে বাংলাদেশের সর্বশেষ রেমাক্রি ইউনিয়নের নাম এ রেমাক্রি চং-এর নাম অনুসারেই।
এই যে শঙ্খ থেকে সাঙ্গু আর অমায়ক্রি থেকে রেমাক্রি নামকরণ, তার কিন্তু রয়েছে বেশ মজার ইতিহাস।
অমায়ক্রি অর্থ প্রধানমন্ত্রী। আর অমায়ক্রি চং অর্থ প্রধানমন্ত্রীর খাল। রেগ্রীইং বোমাংগ্রী বা শঙ্খনদীর রাজা এবং অমায়ক্রি চং বা প্রধানমন্ত্রীর খাল নামের অর্থ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এসব নদী বা খালই হলো এ এলাকার জনবসতি স্থাপন, জীবনধারণ ও শাসনকার্য চালানোর অন্যতম পাথেয়।
থানচি ও রেমাক্রির কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এবং এনজিওকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃটিশ আমলে সরকারি গেজেটিয়ার প্রকাশের সময় বাঙালি আমলারা ‘শঙ্খ নদী’ নাম নথিভুক্ত করে। আর ইংরেজিতে এটা লেখা হয় sangu। সেটা সম্ভবত ১৮৬০ সালের কথা। তবে স্থানীয় অধিবাসী মারমারা প্রাচীনকাল থেকেই একে রেগ্রীইং খ্যং বলে আসছেন।
রেমাক্রির স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা শঙ্খকে সাঙ্গু নামে চিনেছেন ১০-১২ বছর আগ থেকে। মারমারা ‘শঙ্খ’ বা ‘সাঙ্গু’ নদীকে বলে ‘রেগ্রীই খ্যং’। ‘রে’ মানে পানি আর ‘গ্রীই’ অর্থ পরিষ্কার অর্থাৎ রেগ্রীই খ্যং অর্থ পরিষ্কার বা স্বচ্ছ পানি। এখনো তিন্দু, থানচি, বান্দরবানের মানুষ বোমাং রাজাকে রেগ্রীইং বোমাংগ্রী বলে। এর অর্থ শঙ্খনদীর রাজা।
রেমাক্রি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মং ফু অং বাংলানিউজকে জানান, এক সময় আরাকানের এক রাজা ছিলেন। লঞ্চডুবিতে তার মৃত্যু হবে বলে জানতেন তিনি। তাই তার প্রধানমন্ত্রীকে একটি আংটি দিয়ে বলেছিলেন- আমি হয়তো মরে যাবো। তুমি এই আংটিটা রাখো। আমি মারা গেলে তোমাদের রানীর কাছে গিয়ে বলবে- এই আংটিটা যার হাতে সুন্দরভাবে খাটবে সে রানীকে পুনরায় বিয়ে করে রাজা হবে।
একদিন রাজা ও প্রধানমন্ত্রী দু’টো লঞ্চে করে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর লঞ্চটা ছিল সামনে। সত্যিই লঞ্চটা ডুবে মারা যান রাজা। পরে প্রধানমন্ত্রী রানীর কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বললে রানী তাকে বলেন- ‘তুমি রাজাকে মেরে ফেলেছো আমাকে বিয়ে করার জন্য। ’
এমন পরিস্থিতিতে রানীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠলে এই খাল দিয়ে সাঙ্গু নদী হয়ে ত্রিপুরায় গিয়ে রাজ্য স্থাপন করেন ওই প্রধানমন্ত্রী। তখন থেকেই একে প্রধানমন্ত্রীর খাল বা অমায়ক্রি চং বলা হয়।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী আমরা বলতে পারি, ধ্বনিবিপর্যয় থেকে নামের এ পরির্বতন হয়েছে।
এভাবেই শঙ্খ হয়েছে সাঙ্গু, আর অমায়ক্রি হয়েছে রেমাক্রি।
সাঙ্গু নদীর প্রবাহপথটাও বেশ বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘বাংলাদেশের নদনদী বইতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের আরাকান পর্বতে উৎপন্ন হয়ে থানচি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর রুমা, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান সদর ছুঁয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও বাঁশখালী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে সাঙ্গু। উত্তরে আরাকান পর্বত থেকে এর ভৌগলিক অবস্থান ২১.১৩ ডিগ্রি উত্তর ও ৯২.৩৭ ডিগ্রি পূর্বে।
উৎসমুখ থেকে শুরু করে সাগরে পতিত হওয়ার পয়েন্ট পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য ১৮০ কিলোমিটার। দৈর্ঘ্য বিবেচনায় বান্দরবানের বুক চিরে প্রবাহিত অপর দুই সীমান্ত নদী নাফ (৬৪) ও মাতামুহুরি (১২০) এবং বান্দরবানের পাহাড়ি ছড়া থেকে উৎপন্ন হওয়া তিন নদী হারবাংছড়া (২৮), সোনাইছড়ি (২৪.৫০) ও বাঁকখালির (৯০) চেয়ে বড় হওয়ায় সাঙ্গুই সবচেয়ে বড় ও প্রধান নদী এই পাহাড়ি জেলায়।
বারোমাসী প্রবাহের এ নদীর অববাহিকার আয়তন ১২৭৫ বর্গ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ১৫০ মিটার।
সবচেয়ে কম প্রবাহের মাস মার্চ ও এপ্রিল। এ সময় এ নদীতে প্রতি সেকেন্ডে ১ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হলেও সবচেয়ে বেশি প্রবাহের মৌসুম জুলাই-আগস্ট মাসে। সেকেন্ডে ২ হাজার ৭শ’ ঘনমিটার পানি বয়ে যায় সাঙ্গুর বুকে। কম প্রবাহের মৌসুমের গভীরতা ১ মিটার থেকে বেড়ে বেশি প্রবাহের মৌসুমে হয়ে যায় ১৫ মিটার।
এ নদীর চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও বাঁশখালি অংশে নিয়মিত প্রভাব আছে জোয়ার-ভাটার।
ছোটবড় ঝর্ণা থেকে সৃষ্টি হওয়া ছোট ছোট ছড়া এসে মিশেছে শঙ্খ নদীতে। এ নদীর দু’পাড়ের বাসিন্দাদের অধিকাংশই মারমা বা অন্য কোনো নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। তাদের অধিকাংশেরই পেশা আবার জুম চাষ।
কয়েক দশক আগেও এ নদীর দু’তীরে ছিল ঘন বন। সে বনে বিচরণ করতো হাতি, বাঘ, ভালুক, হরিণ, বানর, বনবেড়াল, ময়ূর, হনুমান, উল্লুকসব আরো অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণি। ছিলো অনেক প্রজাতির অজগর। নদীর জলে অবাধে সাঁতরাতো রুই-কাতলা, গলদা চিংড়ি, শোল, মাগুর, সিং, মৃগেলসহ আরো কতো নাম না জানা মাছ।
নদী অববাহিকায় প্রচুর পলি জমতো পাহাড়ি ঢলে। সার ছাড়াই হতো ধান, ডাল, শাক-সবজি, বাদামের বাম্পার ফলন। বান্দরবানের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যমও ছিলো এ নদী। সব মিলিয়ে বান্দরবানবাসীর জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎস ছিলো সাঙ্গু।
কিন্তু নির্বিচারে নদী তীরবর্তী বৃক্ষ নিধনে প্রাণী বৈচিত্র্যের স্বভাবটাই যেন পাল্টে গেছে সাঙ্গুর। একই পাহাড়ে বারবার জুম চাষে ভূমিক্ষয় বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বর্ষাকালে তাই স্বচ্ছজলের নদী হয়ে যায় ঘোলা। ভরাট হওয়া নদীর বুকে বাধা পায় বর্ষার পানি। বর্ষাকালে এখন ঠিকই প্লাবিত হয় নদী অববাহিকার অনেক স্থান। জলাবদ্ধতাও তৈরি হয় কোথাও কোথাও।
সাঙ্গুপাড়ের জমিতে এখন আর পলি জমে না আগের মতো। সার-কীটনাশকেও পাওয়া যায় না কাঙ্ক্ষিত ফলন। কিন্তু নদীর পানিতে বিষ ছড়িয়ে পড়ে ঠিকই। এ নদীর ঝিনুক, কাঁকড়া ইত্যাদি উপকারী পোকামাকড়ের তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে উঠেছে।
যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।
থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।
বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন। খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড।
বান্দরবানের বৈচিত্র্যময় নানা বিষয়ে জানতে নিচের লিংকগুলি দেখুন
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৩
জেডএম/