ঢাকা: ভাই, ৯বছর বয়স থেকেই পেটের দায়ে ট্রাকের হেলপারি করি। স্বপ্ন ছিল, লেখাপড়া যেহেতু করতে পারিনি, ছোট ভাই-বোন ও সন্তানদের বড় মানুষ বানাবো।
হেলপার থেকে ড্রাইভার হই। খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাই। কিছু টাকা জমানোর পর একটা পুরান ট্রাক কিনি। টানা ১৩ বছর চেষ্টা করে গত ১০দিন আগে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটি পিকআপ ট্রাক নামাই।
আজই (১২ মে রোববার) প্রথম কাঁঠাল বোঝাই করে ঢাকায় আসছি। সকাল হয়ে যাওয়ায় হরতালের কথা ভেবে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে পাহারা দিচ্ছি।
এক মিনিটের জন্যও ঘুমাইনি। ১৫ জন শিবিরকমী নতুন গাড়ি ভাংচুরের পর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমি তাদের পা ধরেছি। বলেছি,‘‘ আমার সব স্বপ্ন গাড়ির মধ্যে।
কিন্তু তারা আগুন ধরিয়ে আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দিছে। ’’ কথাগুলো যাত্রাবাড়ির মীর হাজারীবাগ মাদ্রাসাগলি এলাকায় কাঁদতে কাঁদতে বলছে পিকআপ চালক ও মালিক নয়ন।
নয়ন জানায়, বাবা গিয়াসউদ্দিন, বাড়ি চট্টগ্রাম জেলায়। তিন ভাই দু’ বোন। দু’ সন্তান দু’ ভাই, এক বোন লেখাপড়া করে। অসুস্থ বাবা-মা’র খরচ তাকে বহন করতে হয় ট্রাক চালিয়ে।
‘’অনেক স্বপ্ন ছিল, ব্যাংকের দেনা শোধ করে আরো দু’টো ট্রাক কিনবো। কিন্তু সব শেষ। ভিক্ষা ছাড়া কোন উপায় নেই। ’’
এভাবে হরতাল নামের নোংরা রাজনীতির বলি হাজারো নয়ন। কিন্তু এই নয়নরা হরতালের বলি হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।
নয়ন আরো জানায়,‘‘যখন পেট্রোল ঢালছে, তখন হুজুরদের পা ধরেছি। বলেছে, আমার গায়েও পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগাতে। কিন্তু এসব হুজুররা মুহুর্তে আগুন ধরিয়ে দিল। ’’
যাত্রাবাড়ি থানা হাজতে দু’ হুজুরকে দেখিয়ে ধিক্কার দিয়ে নয়ন বলেন,‘‘ তোদের যারা জন্ম দিয়েছে তাদের ওপর, হরতাল যারা দেয় তাদেরও গজব পড়বে। আমি কিভাবে টাকা শোধ করবো বলতে পারি না। ’’
নয়ন জানান,‘‘বিল্লাল নামে এক হরতাল সমর্থনকারী হুজুরকে আমি পা জড়িয়ে ধরলে সে আমাকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুসি ও ইটপাটকেল মারে।
কিন্তু বিল্লাল নামের হুজুর তার হাতে থাকা পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ট্রাকের সামনের অংশের সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকি। ’’
এরই মধ্যে এলাকাবাসী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে পুলিশ যাত্রাবাড়ি তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা থেকে বিল্লাল হোসেন ও আরো এক ছাত্রকে আটক করে। দু’জনই ওই মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষের ছাত্র।
এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি/তদন্ত) অবনী শংকর কর বলেন,‘‘ সকাল পৌনে সাতটায় তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা থেকে দু’জনকে আটক করা হয়েছে।
তবে; হরতালে নয়নের যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষানোর মতো নয়। যাত্রাবাড়ি ও ডেমরা এলাকায় শতাধিক মাদ্রাসাছাত্র তাদের শিক্ষকদের ইন্ধনেই এসব করেছে। ’’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত পথচারি সোহেল চৌধুরী বলেন,‘‘ ফজরের নামাজের সময় কেউ এসব করতে পারে ভাবতেও পারি না। এসব ইসলামের কথা? ইসলামের শিক্ষা কি হরতালের নামে এসব করা?
নয়নের কান্না দেখে খুবই খারাপ লাগছে। তবে; যাদের খারাপ লাগার কথা তাদের লাগবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ’’
একই দিন মিরপুর-১ এলাকায় তানজিল পরিবহনের দু’টো গাড়িতে আগুন দেয় শিবির কমীরা।
বাস মালিক কিরণ জানিয়েছে, অভাবের সংসারে পিতা-মাতার জায়গা বিক্রি করে পাড়ি জমায় সৌদি আরবে।
‘৯বছর প্রবাস জীবন সব সঞ্চয় ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে দু’টো বাস কিনি। ’
দুইটি বাসের আয় দিয়েই চলছিল কিরণ মিয়ার পুরো পরিবার। বাসের আয়ে ব্যাংক লোন, ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া, সংসার সব চলে। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে হঠাৎ সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় এনে সিরিয়াল দিয়ে নাস্তা সারতে যান ড্রাইভার ও হেলপার। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় জামায়াত-শিবিরকর্মীরা।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে বাসটি জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন।
কিরণ বিলোপের সূরে জানান,‘‘
“হায় আল্লাহ আমার এখন কি হবে। কি ভাবে চলবে আমাদের সংসার। ব্যাংকের কিস্তি দিব কেমনে। আমার যারা সর্বনাশ করছে আল্লাহ তুমি তাদের বিচার করো। ”
হরতালের নয়ন, হিরণদের প্রতিনিয়ত কপাল পুড়ছে। এদের খোঁজ কেউ রাখে না। পুলিশও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি জিডি করে দায় সারে। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর ভুলে যায় সবাই।
প্রতিনিয়ত বাড়ছে এই ধ্বংসযজ্ঞ। আর রাজনৈতিক দলের কর্মীদের বাহাদুরি যেন সব বাসের ওপরেই। হরতাল বা কোনো কর্মসূচির প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় এমনিতেই নেমে পড়েন ধ্বংসযজ্ঞে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৪ ঘণ্টা, ১৪ মে, ২০১৩
আরইউ/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর