ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

এক রাতের গণিতবিদ এভারিস্ট গ্যালোয়া

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:২৩, মে ১৬, ২০১৩
এক রাতের গণিতবিদ এভারিস্ট গ্যালোয়া

আজ তোমাদের এমন একজন গণিতবিদের কথা বলব যার জীবনটি এত বিচিত্র যে কোনো গল্প উপন্যাস বা নাটকেও সে রকম বিচিত্র জীবন খুঁজে পাওয়া যাবে না। রূপকথার রাজপুত্রের মতো সেই প্রায় কিশোর গণিতবিদ প্রথমবার গণিতের সাথে পরিচয় হয় যখন তার বয়স ষোল এবং তার মৃত্যুর হয় যখন তার বয়স কুড়ি এবং গণিতের ওপর তার পুরো কাজগুলো লিখে রাখে মাত্র এক রাতে এবং তারপরও গণিতের জগৎ তাকে স্মরণ করে গভীর ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায়।



এই গণিতবিদের নাম এভারিস্ট গ্যালোয়া। ফরাসি বিপ্লবের বাইশ বছর পর ১৮১১ সালের ২৫ অক্টোবর প্যারিসের দক্ষিণে একটি ছোট গ্রাম বুর্গ লা রিন- এ তার জন্ম হয়েছিল।

সেই সময়টি ছিল অস্থির এবং অস্থিতিশীল এক সময়। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তখন সাফল্যের চূড়ান্তে। কিন্তু তখন তার দুর্ভাগ্যের সূচনা শুরু হয়ে গেছে। তিনি ক্ষমতায় আসছেন এবং যাচ্ছেন- কখনো দেশে রাজতন্ত্র কখনো প্রজতন্ত্র এবং এসব কিছু নিয়ে ফ্রান্সের তখন এক ভয়ঙ্কর টানাপোড়েন।

এরকম অবস্থায় গ্যালোয়া প্রথম স্কুলে যান বারো বছর বয়সে, স্কুলের নাম লিসে দ্য লুই ল গ্রঁ। তখনকার দিনে সেটি ছিল একটি নামকরা স্কুল কিন্তু সেখানে খুব কড়া শাসন। স্কুলটি কার হাতে যাবে তখন সেটি নিয়ে খুব আলোচনা চলছে, জোর গুজব স্কুলটি ধর্মযাজকদের হাতে দিয়ে দেয়া হবে। ধর্মযাজকরা রাজতন্ত্রের পক্ষে, কিন্তু ছাত্ররা প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিকের পক্ষে। তারা কিছুতেই চায় না স্কুলটি ধর্মযাজকদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হোক, সেটি নিয়ে তারা আন্দোলন করছে।

স্কুলের প্রিন্সিপাল সেই আন্দোলনের খবর পেয়ে একদিন আন্দোলনের পরিকল্পনাকারী ডজনখানেক ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে দিলেন। পরদিন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে বলা হলো তারা যেন রাজতন্ত্রের সমর্থনে অষ্টাদশ লুইয়ের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। উচু ক্লাসের তেজস্বী ছাত্ররা রাজি হলো না, সাথে সাথে আরো এক শ ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হলো। গ্যালোয়া তখন ছোট, মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে কিন্তু তারপরেও উচু ক্লাসের ছাত্রদের প্রতি এই অবিচার তার মনে একটা গভীর রেখাপাত করেছিল, রাজতন্ত্রের জন্যে ঘৃণা, প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিকের জন্যে ভালোবাসা এবং সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহের ভাব তখনই তার ভেতরে দানা বেঁধে উঠতে থাকে।  

সারা ফ্রান্সে যখন এক ধরনের অস্থিরতা কিশোর গ্যালোয়া তখন তার স্কুলে পড়াশোনা করছে। পড়াশোনায় মোটামুটি, তবে চোখে পড়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু হঠাৎ করে শান্তশিষ্ট নিরীহ গোবেচারা ধরনের এই কিশোরটির মাঝে ভয়ঙ্কর পরিবর্তন দেখা গেল। তখন তার বয়স ষোলো এবং স্কুলে তার ক্লাসে প্রথমবারের মতো গণিত বিষয়টি পড়ানো শুরু হয়েছে। গণিতের বিস্ময়কর সৌন্দর্য দেখে গ্যালোয়ার গণিতের জগতে প্রবেশ করে এতই অভিভূত হয়ে গেল যে সে গণিত ছাড়া অন্যসব কিছু পড়া ছেড়ে দিল। দিনরাত শুধু গণিত আর গণিত, যে ছেলেটি নিরীহ ভালোমানুষ ছিল হঠাৎ করে সে যেন খেপে গেল, অবাধ্য হয়ে গেল, গণিত ছাড়া অন্য সবকিছু ভুলে গেল। স্কুলের রিপোর্ট কার্ডে দেখা গেল গণিত ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সে খারাপ করতে শুরু করেছে।

২.

গণিতের সাথে গ্যালোয়ার পরিচয় হয়েছে ষোলো বছর বয়সে এবং সতেরো বছর বয়সে গণিতের জার্নালে তার প্রথম গবেষণাপত্র ছাপা হলো। মোটামুটিভাবে গ্যালোয়া তখন তার নিজের ক্ষমতার কথা বুঝতে শুরু করেছে। সে জানে গণিত নিয়েই তার বাকি জীবন কাটবে। তাই সে ইকল পলিটেকনিক নামে দেশের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করলো। শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালো তাই নয় সেখানে রিপাবলিকের পক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা প্রচুর, তাদের পক্ষে আন্দোলনের সেটি সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। গ্যালোয়ার রাজনীতিতে খুব উৎসাহ, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে আন্দোলনে অংশ নিতে পারবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে। তাকে যে প্রশ্ন করা হলো তার উত্তরগুলো সে দিল খুব সংক্ষেপে- উপস্থিত যারা ছিল তারা সেগুলো বুঝতেই পারল না। কাজেই একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে গেল, গ্যালোয়া ভর্তিই হতে পারল না। আশাহত গ্যালোয়া ধৈর্য ধরে অপেক্ষা পরের বছর আবার ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছে। যে ভদ্রলোক গ্যালোয়ার ধারে-কাছে নয়। তাই দেখা গেল তিনি তার কোনো প্রশ্নের উত্তরই বুঝতে পারছেন না। গ্যালোয়া যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারল তখন রাগে দুঃখে হতাশায় খেপে একসময় পরীক্ষকের দিকে ডাস্টারটা ছুড়ে মারল। একেবারে নিখুঁত নিশানা- তারপর যা হবার তাই হলো, ইকল পলিটেকনিক ভর্তি হবার সম্ভাবনা একেবারে চিরদিনের জন্যে শেষ হয়ে গেল।

৩.

গ্যালোয়ার এবারে এক ধরনের জেদ চেপে যায়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশা ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজে গণিত নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। তার আগ্রহ ছিল ত্রিঘাত, চতুর্ঘাত বা পঞ্চঘাত সমীকরণে। গ্যালোয়া অনেক খাটাখাটুনি করে দুটি রিসার্চ পেপার তৈরি করে সেগুলো একাডেমি অব সায়েন্সে জমা দিল। তখন এই পেপারের বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ কশি। তিনি পেপার দুটি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন, তিনি বুঝতে পারলেন গণিতের জগতে একজন নতুন তারকার জন্ম হয়েছে।

তিনি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে একাডেমির সবচেয়ে বড় পুরস্কারের জন্যে এই পেপার দুটোকে মনোনয়ন দেয়া যায়। তবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হলে পেপারগুলো একটু ভিন্নভাবে সাজাতে হয়। তাই কশি গ্যালোয়াকে পেপার দুটি ফেরত দিয়ে নিয়মতো সাজিয়ে দিতে অনুরোধ করলেন। কশির মতো এত বড় একজন গণিতবিদের কাছ থেকে নিজের কাজের স্বীকৃতি পেয়ে গ্যালোয়ার উৎসাহ শতগুণে ফিরে এলো, ইকল পলিটেকনিক ভর্তি হতে না পারা দুঃখ গণিতবিদদের কাছে নিজের ক্ষমতাটি প্রকাশ করতে না পারার হতাশা সবকিছু এক মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। তরুণ এই গণিতবিদ পেপার দুটোকে সাজানোর কাজ শুরু করে দিল।  

৪.

বছর ঘুরতেই(১৮২৯) রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গ্যালোয়ার বাবা আত্মহত্যা করেন।

পিতার মৃত্যুর পর গ্যালোয়া প্যারিস ফিরলেন। অসমাপ্ত কাজ শেষ করে তার পেপার দুটি জমা দিলেন একাডেমির সেক্রেটারি স্যার জসেফ ফুরিয়ারে কাছে । কিন্তু সেবার গ্যালোয়া পুরস্কার পাননি । পুরস্কার ঘোষণার কিছুদিন আগে ফুরিয়ার মারা যান এবং তার গবেষণাপত্র যে জমা হয়েছে এমন কোনো ডকুমেন্টের অস্তিত্বই ছিল না । ফলে রাজনৈতিক কারণে গ্যালোয়ার গবেষণা গায়েব হয়েছে বলে তার সন্দেহ হয় ।

এই সন্দেহ পুরোপুরি বাস্তবে প্রমাণি হয় যখন তার পরে একাধিক গবেষনা পত্র একাডেমি অব সায়েন্স ফেরত পাঠায় অযৌক্তিক যুক্তি দেখিয়ে (১৮৩০)। সে বছর গ্যালোয়া মোট ৩টি গবেষনা পত্র প্রকাশ করেন।

যার মধ্যে একটি বিখ্যাত ‘গ্যালোয়স থিউরি’ ভিত্তি গড়ে দেয়। অন্য দুটি ছিল আধুনিক উপায়ে সমিকরণের মূল নির্ণয় সম্পর্কিত এবং নাম্বার থিওরি নিয়ে । সে বছর গ্যালোয়া তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালককে গালিগালাজ করে একটি প্রতিবেদন লেখেন ।

পরিচালক ছিলেন প্রজাতন্ত্রের সমর্থক। সুতরাং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া হয় । এর পর তিনি যেন পুরোই উচ্ছনে গেলেন । বছর ঘুরতেই(১৮৩১) মদ আর সন্ত্রাস তার নিত্যসঙ্গী। কখনও চাকু হাতে সম্রাটকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন খোলা রাস্তায়, তো তারপরই গ্রেফতার। ছাড়া পেয়ে আবার নিষিদ্ধ জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক পরে রাস্তায় বের হলে তার জেল হয়ে যায় । এক মাস পর গ্যালোয়া জেল থেকে ছাড়া পান ।

এরপর হুট করেই একদিন দেখা গেল স্টেফানি ফেলিসি নামে প্যারিসের একজন খ্যাতনামা ডাক্তারের মেয়ের সাথে গ্যালোয়ার গভীর ভালোবাসা হয়েছে। মেয়ের বাবা পাসচু দরবনভিল এই ঘটনায় খুব রেগে গেলেন। অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শুটিং ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ দেন গ্যালোয়াকে ।

পাসচু খ্যাতনামা শুটারও ছিলেন। পিস্তল চালাতে পারদর্শী। কাজেই সে গ্যালোয়াকে সামনাসামনি ডুয়েলে আহ্বান করল। একটা নির্দিষ্ট দুরত্বে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনকে গুলি করবে- ভয়ঙ্কর একটি প্রস্তাব, কিন্তু তেজস্বী গ্যালোয়া এক কথায় রাজি হয়ে গেল।

ডুয়েলের আগের রাতে গ্যালোয়া হঠাৎ করেই বুঝতে পারল হয়তো এই রাতটিই তার জীবনের শেষ রাত। অসাধারণ প্রতিভাধর এই গণিতবিদ গণিত নিয়ে তার চিন্তাভাবনা, আবিষ্কার কিছুই কোথাও লিখে রাখেনি, কিছুই কোথাও প্রকাশ হয়নি। পরদিন ডুয়েলে যদি সে মারা যায় পৃথিবীর কেউ আর সে কথা জানতে পারবে না। তেজস্বী ক্রুদ্ধ ভাগ্যহত এই গণিতবিদ তখন কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসল। এই রাতটিতেই তাকে সবকিছু লিখতে হবে।

গ্যালোয়া রাত জেগে তার থিওরেমগুলো লিখতে শুরু করল। হাতে সময় নেই, দ্রুত লিখে চলছে। লিখতে লিখতে সে দেখে সময় চলে যাচ্ছে, কাগজে লিখছে, ‘ইশ হাতে সময়- একেবারে সময় নেই’ মাঝে মাঝে মেয়েটির নাম লিখছে, তারপর আবার থিওরেমগুলোতে ফিরে আসছে। লিখতে লিখতে রাত ভোর হয়ে এলো। সে তখন তার এক বন্ধুকে চিঠি লেখে বলল, সে যদি পরদিন মারা যায় তাহলেণ তার এই এক রাতের লেখাগুলো যেন ইউরোপের বড় বড় গণিতবিদদের হাতে পৌছে দেয়া হয়। সাধারণ মানুষ এর গুরুত্ব না বুঝলেও তারা সেটি বুঝবে।

পরদিন, ১৮৩২ সালের ৩০ মে, একটা নির্জন মাঠে গ্যালোয়া এবং পাসচু দরবনভিল উদ্যত অস্ত্র হাতে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। গ্যালোয়া একা, পাসচুর সাথে আছে তার সহকারী। একজন আরেকজনকে গুলি করল, দুজনের ভেতরে পঁচিশ পা দূরত্ব, গ্যালোয়ার অপটু হাতের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো কিন্তু নিষ্ঠুর পাসচুর দক্ষ হাতের গুলিতে গ্যালোয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মাত্র বিশ বছর বয়সে সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ গণিতবিদের বিচিত্র জীবনের ইতি হলো এভাবে।

৫.

তারপর দীর্ঘ দশ বছর কেটে গিয়েছে। গ্যালোয়ার জীবনের শেষ রাতে লেখা কাগজগুলো তার বন্ধু ইউরোপের বড় বড় গণিতবিদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল কিন্তু কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাননি। অস্থির গ্যালোয়ার বিচ্ছিন্ন সামঞ্জস্যহীন লেখা থেকে তার প্রকৃত মর্মোদ্ধার করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না।

কাগজগুলোর একটা কপি শেষ পর্যন্ত জোসেফ লিউভিলের কাছে পৌঁছাল, এই মেধাবী গণিতবিদ সেই কাগজগুলো থেকে তার প্রকৃত তথ্যগুলো বের করলেন। গ্যালোয়ার খাপছাড়া বিচ্ছিন্ন লেখাগুলো থেকে মর্মোদ্ধার করে সেগুলো তিনি দেশের সবচেয়ে সম্মানিত জার্নালে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। পৃথিবীর গণিতবিদরা তখন সবিস্ময়ে এই তরুণ গণিতবিদের বিস্ময়কর আবিষ্কারের সাথে প্রথমবার পরিচিত হলেন। গভীর শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায় তাদের মাথা নত হয়ে এলো।

এক রাতের গণিতবিদন পৃথিবীর মানুষের স্বীকৃতি এবং ভালোবাসা পেলেন, কিন্তু বড় দেরি করে।

তথ্যসূত্র: নিউরনে আবারো অনুরনন- ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ

বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৩
সম্পাদনা: এসএএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।