ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পাহাড়ের পাথর পুরাণ

আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:২০, মে ১৭, ২০১৩
পাহাড়ের পাথর পুরাণ

রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা আনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও ক্রেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।

পাহাড়ের কোল বেয়ে বঙ্গোপসাগর পানে ছুটে চলা সাঙ্গু-মাতামুহুরি অন্যরকম এক আবহ যোগ করেছে বান্দরবানের নিজস্ব সৌন্দর্যে। আকর্ষণ আরো বাড়িয়েছে চিম্বুক ও বগা লেক, ঋজুক ঝরণা, শৈল প্রপাত। জেলাজুড়েই যেন ছড়িয়ে আছে নয়নজুড়ানো সৌন্দর্য। পাহাড়ের আদরে বসে শরীরে মেঘ মাখার বিরল সুযোগও হরহামেশা পাওয়া যায় বান্দরবানে। ১১ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ছাড়াও বাংলাভাষীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে বান্দরবান জেলায়। সম্প্রতি বান্দরবান ঘুরে এসেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম। স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূরে আলমও ছিলেন সঙ্গে।
বান্দরবান থেকে ফিরে: সাঙ্গুর বুকে ভেসে আমরা তখন তিন্দু পার হচ্ছি। আর কিছুটা সামনে এগুলে বড়পাথর এলাকা। পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।

সাঙ্গুর স্বচ্ছজলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় পাথর। পাথর কাটিয়ে চিকন ধাঁচের নৌকা এগিয়ে চলেছে সর্পিল গতিতে।

বড় পাথর পৌঁছেই চিৎকার দিয়ে উঠলাম ‘এসে গেছি’ বলে।

মাঝি দু’জন যেন হঠাতই চুপ মেরে গেলো। নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ। টানতে হবে এখন। বড় বড় পাথরের ফাঁকে চলা কঠিন।

নৌকা টানার জন্য সাঙ্গুর হাঁটু পানিতে নামলো মাঝি। একে তো নৌকার ভার কমানো দরকার, তারওপর ঘণ্টা দুয়েক নৌকায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকার পর সাঙ্গুর পাথুরে পাড়ে হাঁটার লোভটাও সামলানো যাচ্ছিলো ন‍া।
আমরাও নামলাম নৌকা থেকে।

নদীর বুকে বিছিয়ে ‍আছে অসংখ্য পাথর। কোনকোনটা নুড়ির সমান, কোনটা আবার জুমঘরের আয়তন নিয়ে বসে আছে সাঙ্গুর বুকে।

এমন পাথুরে জলপথ দেখিনি আগে। তাই স্বভাবতই আলোচনায় উঠে এলো পাথরগুলো। এগুলো নিয়ে নানা কথা বলতে শুরু করলাম আমরা। তখনো বুঝিনি কি রহস্য লুকিয়ে আছে এসব পাথরে।

এসব পাথরের প্রতি বিনয়াবনত মাঝিদের কথা শুনে আমরা তো অবাক। প্রথমেই বাজে মন্তব্য করতে নিষেধ করে দিলো তারা। তাদের গল্পে আমাদের সামনে একে একে খুলতে লাগলো পাথর কাহিনীর ভাঁজ।

আমরা জানলাম, পড়ে থাকা পাথরগুলো সাধারণ কোনো শিলাখণ্ড নয়। এগুলোকে জড়িয়ে আছে রহস্য, ভয়, শ্রদ্ধা। এ এলাকার মানুষের শত শত বছরের বিশ্বাসমাখা কিংবদন্তিও জড়িয়ে আছে এসব পাথরের নিরেট শরীরে।

রাজাপাথর বা বন্দপাথর
কথিত আছে, ভ্রমণের সময় এ পাথরটার উপর মুকুট রেখে বিশ্রাম করছিলেন রাজা। এর পর থেকে এর নাম হয়ে গেছে রাজাপাথর। মারমা ভাষায় ‘বন্দ’ অর্থ মুকুট বা রাজার মুকুট।

আরাকানের রাজা টেকনাফ হয়ে এ পথ দিয়েই তার রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। এখানে যাত্রাবিরতির সময়ে এ পাথরটির ওপরে মুকুট রেখে বিশ্রাম নিয়েছিলেন তিনি। তার পর থেকে এ পাথরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক কল্পকাহিনী।

আমরা যখন নৌকায় করে রাজাপাথরের কাছে পৌঁছুলাম তখন নৌকার এক মাঝি বলে উঠলো, “খবরদার! রাজাপাথর নিয়ে কেউ কোনো বাজে মন্তব্য করবেন না, ক্ষতি হবে। ”

পাথরের কাছে পৌঁছুতেই দেখা গেল- সেটার মধ্যে বড় এক গর্ত। সেই গর্তে জ্বালানো মোম, মোমের পোড়া সলতে।

জানা গেল, অনেকে এখানে টাকা পয়সা রেখে যায়, মানত করে। বিপদের সময় ফের এখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা-পয়সা ধার নেয় মানতকারী। পরে সুবিধামতো ধার করা টাকা ফেরত দেয় পাথরের গর্তে।

কেউ এ পাথরকে অবমাননা করে কথা বললে তার অনেক ক্ষতি হয় বলে বিশ্বাস পাথর পূজারিদের।

পাথরটি বিশাল। আগে ছিলো আরেকটি পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে। এখন অনেকটাই কাত হয়ে গেছে। আমরা সাহস করে পাথরটির কাছাকাছি গেলাম। কোন মানত না করলেও পকেটে হাত দিলাম রাজাপাথরের গর্তে কিছু টাকা দেবো বলে।

কিন্তু ভাগ্য খারাপ। পাথরটার পাশ দিয়ে ভুশ করে এগিয়ে গেলো নৌকা। ‘পাথরদেবতা’কে পেছনে ফেলে আমরা তখন ফিরতি পথের যাত্রী।

কলস পাথর
পাথরটির গায়ে থরে থরে সাজানো কলস আকারের বেশ ক’টি ছোট পাথর। এর মাঝে আবার এমন একটা গর্ত- দেখলে মনে হয় কেউ বুঝি কলস তুলে নিয়ে গেছে এখান থেকে।

পরে জানা গেল, সাঙ্গুর মাছ ধরা এ এলাকার মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস। একসময় এক জেলে মোহরের লোভে এই পাথরের মধ্যে থাকা একটি কলস নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলো। কিন্তু সে জেলের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। পাথরের অভিশাপে পথেই মৃত্যু হয় তার।

ওই ঘটনার পর থেকে আদিবাসীরা পাথরটিকে পূজা করতে শুরু করে।

বাঘপাথর
বাঘ পাথরটির কাছে যখন পৌঁছ‍ুলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পড়ন্ত আলোতেই স্পষ্ট চোখে পড়লো পাথরে খোদাই করা বাঘের চোখ-মুখ। মাঝিই প্রথম জানালো-এর নাম বাঘ পাথর।

বাঘ পাথরের গায়ে একটি ছিদ্র। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ছিদ্রটি করার সময় ক্ষতি হয়েছিল মানুষের। যিনি ছিদ্র করেছিলেন তার মৃত্যু হয়েছিলো সেখানেই। বাঘ যেমন মানুষ খায়, বাঘ আকৃতির এই বাঘরূপী পাথরটিও মানুষ খেয়েছিলো সেদিন। তখন থেকেই মানুষ এর নাম দিয়েছে বাঘ পাথর।

এমনতরোভাবে গড়া ওঠা অনেক কাহিনীতে  বিশ্বাস করেই পূর্ণ হয় পাহাড়িদের জীবনচক্র। প্রজন্মের পর প্রজন্মের বিশ্বাসে ভর করে সময়ের সীমারেখা অতিক্রম করে এসব মিথ বা পুর‍াণ সব সময়ই সমসাময়িক হিসেবে থেকে যায়।

যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।

থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।

বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন।   খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড।

বান্দরবানের বৈচিত্র্যময় নানা বিষয়ে জানতে নিচের লিংকগুলি দেখুন

বাংলাদেশ সময: ১১৩৮ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৩
জেডএম/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।