ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

ম্রো মিথ: পাহাড়ের উপকথা, ধর্ম বিশ্বাস

আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৪৩, মে ১৮, ২০১৩
ম্রো মিথ: পাহাড়ের উপকথা, ধর্ম বিশ্বাস

বাংলানিউজের অনুসন্ধানী টিম সম্প্রতি গিয়েছিল বান্দরবানে। থানচি, তিন্দু, রেমাক্রি, ছোটমোদকের মতো দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়।

নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজমীর সানজিদা আলম সরেজমিন ঘুরে সেসব এলাকার মানুষের সঙ্গে থেকে, কথা বলে চেষ্টা করেছেন তাদের দুঃখ, কষ্ট, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, সমস্যা, সম্ভাবনার স্বরূপ জানতে। সঙ্গে ছিলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম

বান্দরবান থেকে ফিরে: ভর দুপুর। পাহাড়ি বনে আপনমনে কাঠ কাঠছিলো  উ লা চিং। হঠাৎ কোন এক নারীর সুরেলা কণ্ঠের ডাকে হাত থেমে যায় তার। কুঠার ফেলে আরো গহীন বনে খুঁজতে থাকে অচেনা সুন্দরীকে। কিন্তু সেই সুন্দরীর দেখা মেলে না আর। পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরে পাগল হযে যায় উ লা চিং।

এমনতরো হাজারো উপকথা মিশে আছে পাহাড়ের আদিবাসী বিশ্বাসে। তাদের দেবতা-অপদেবতাদের অধিকাংশই নারী। আর  ম্রো সম্প্রদায় পাহাড়ের প্রাচীনতম জাতি হওয়ায় পুরাণ ভাণ্ডারটা তাদের যেন একটু বেশিই সমৃদ্ধ।  

ম্রো শব্দের অর্থ মানুষ। সর্বপ্রাণবাদী ম্রোরা পাহাড়ের তুলনামূলক উঁচু স্থানে বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শিক্ষার দিক দিয়ে তারা অনেক পিছিয়ে। আধুনিক সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ কম থাকায় এখনো সহজ-সরল। তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজ-কবজ আর ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের বেঁচে থাকার শক্তি। অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা পেতে গরু, মুরগি, শুকর বলি দেয় তারা। আবার পূজা করে পাথর, গাছ, জলাশয় ইত্যাদির। bandarban-3

খ্যাংমা ওয়াইডং কিংয়ের খোঁজে
মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষে থানচি উপজেলা। এ উপজেলার শেষ প্রান্তের ইউনিয়ন রেমাক্রি। আর এ ইউনিয়নের ম্রো অধ্যুষিত এক লোকালয়ের নাম আদা পাড়া। পাড়া প্রধান ৭৫ বছর বয়সী কারবারি আদা ম্রো’র বাসায় আরো ক’জন বয়োজ্যেষ্ঠ পাহাড়িদের সঙ্গে বসে লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা পাহাড়ি আলু খেতে খেতে চলে বাঁশের মাচাং ঘরের আড্ডা। আড্ডায় উঠে আসে তাদের জীবনাচরণের নিত্যসঙ্গী নিজস্ব পুরাণ, কিংবদন্তি ও ধর্মীয় বিশ্বাস।

তারা জানান, খ্যাংমা হলো খ্যাং গোষ্ঠীর নারী জাতি। আর খ্যাংমা ওয়াইডং কিং তাদেরই এক ধনী নারী। ম্রোরা এই খ্যাংমার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। আদা ম্রোর কাছ থেকে শোনা যায়, খ্যাংমা নাকি বহুদিন ধরে ধনী নারী হিসেবে সমগ্র জাতির কাছে পরিচিত ছিলেন। তার অঢেল সোনা, রূপা, মোহর ছিল। তার এই বিপুল অর্থসম্পদ মারা যাওয়ার সময় নাকি পাহাড়ের পাথরে পরিণত হয়েছে। পাথরে খুঁজলে নাকি সে সম্পদ পাওয়া যাবে। খ্যাংমা পুনরায় জীবিত হয়ে খুঁজে পাওয়া ব্যক্তিকে বর দান করবে। তাই তারা পাথরকে ভক্তি, শ্রদ্ধা করে, পূজা করে। যদি কোনোদিন খ্যাংমা তাদের দেখা দেয়!

ধানপুরাণ
আর সব পাহাড়ি গোষ্ঠীর মতো ম্রোদেরও বেঁচে থাকার প্রধান স্বপ্ন জুমচাষ। জুমের প্রধান ফসল ধান। তাই প্রতিবছর জুমে ধানের ফলন ভালো পাওয়ার জন্য এক ধরনের পূজা দেয় চাষীরা।

তাদের মতে, ধানের একজন দেবতা রয়েছেন। তিনি নারী। নাম মাইনোমা। মাইনোমা বুড়ি, বহুরূপী। জুমের মৌসুমে যখন পাহাড় পোড়ানোর পর জমি প্রস্তুত করা হয় তখন তারা মাইনোমাকে কখনো শিশু, কখনো সুন্দরী নারী, কখনোবা বুড়ি রূপে জুমের খেতে দেখতে পায়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী তারা প্রতিবছরই দেখতে পায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখতে পায় নারীরা। আর মাইনোমাকে যখন যে রূপে দেখতে পায় তখন তাকে ধরে এনে পূজা করে। পূজা পরিচালনা করে নারীরা। ফসল রোপণের আগেই তাদের এ পূজা করতে হয়। bandarban-5

যে বছর ফসল ভালো হয় না, সে বছর পূজা ঠিক হয়নি বলে মনে করে তারা। তাই মাইনোমা তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবী।

অপদেবতা রুখমা
এই দেবতাও নারী। ভয় দেখানো এবং মানুষকে পথভ্রষ্ট করে পাগল করাই তার প্রধান কাজ। রুখমা বহুরূপী। রুখমা দেবীর কথা উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো বাস্তব উদাহরণ টেনে আনলেন সেখানে উপস্থিত আদা ম্রো, তার ভাই এবং সুমন ত্রিপুরা।

রুখমাকে খুব ভয় পায় ম্রোরা। কারণ সে মাঝে মাঝে পরিচিত মানুষের রূপ ধরে ডেকে নিয়ে যায়, আবার কখনো লোভ দেখিয়ে বা সুন্দরী নারীর রূপ ধরে বিপথে নিয়ে যায়। তাদের দেওয়া একটি উদাহরণ দিয়ে রুখমার আসল রূপ তুলে ধরা যাক।

একদিন দুপুরে বনে কাঠ কাটতে গিয়েছিল তাদের পার্শ্ববর্তী পাড়ার উ লা চিং। বন থেকে এক সুন্দরী নারী তাকে কাছে ডাকে। তিনি কাছে গেলে বলে তোমার স্ত্রী সামনে আছে চলো আমার সঙ্গে গেলে তাকে দেখতে পাবে। তখন তিনি তার পিছু পিছু যান। একটু এগিয়ে যাওয়ার পর আরেকটু সামনে ডাকে, তারপর আরেকটু। এভাবে একসময় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে যখন কিছু মেলে না তখন সে পাগল হয়ে যায়।

গুরফি পাড়ার আরেক নারীর স্বামী সকালে উঠে যায় জুমে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর স্বামীকে বাড়ি দেখে বলে, তুমি বাড়ি কেন! সকালে না তুমি জুমে গেলে! তারপর স্ত্রী গেল পানি আনতে। পানি নিয়ে এসে দেখে তার স্বামী নেই। খুঁজতে বের হলে তার স্বামী হঠাৎ দেখা দিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে নিয়ে যায়। তারপর একসময় হঠাৎ উধাও হয়ে যায় স্বামী রূপ রুখমা। পঁয়ত্রিশ বছরের সংসার জীবন তাদের। কিন্তু একদিনের অক্লান্ত বিভ্রান্তির কারণে স্ত্রীটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তারপর নাকি দু’বছর ধরে তাবিজ-কবচ করে এখন একটু ভালো। এভাবেই ক্ষতি করে অপদেবতা রুখমা।

এই অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা শুকর, মুরগি, ছাগল প্রভৃতি বলি দিয়ে মাংস বিলি করে ও নিজেরা খায়।

তুই বু তাইbandarban-6

তুই বু তাই নদীর পূজা। নদীপূজাও তাদের নিত্যদিনের জীবনের অংশ। নদীর জল-হাওয়াই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই নদীকে কেন্দ্র করেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর মাঝে গড়ে উঠেছে নানা বিশ্বাস। তুই বু তাই এমনই এক পূজা।

যাদের জীবনে উন্নতি হয় না, সন্তান হয় না, নানা বিপদে আপদে পতিত হয় নিত্য দিন, তারাই মূলত এই পূজা করে। পূজার উপকরণ হিসেবে থাকে বলির ছাগল, মুরগি, ফুল (বিশেষ করে জবা) প্রভৃতি। এসব দিয়ে নদীকে সন্তুষ্ট করলে এবং তাবিজ-কবচ নিলে দুঃসময় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে তারা বিশ্বাস করে।

তারা নিজেরা যে কাপড় বোনে, সে কাপড় থেকে সবথেকে ভালোটা কাকে দিচ্ছে না দেখে পেছনে ফেলে দিলেও এসব বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে তারা বিশ্বাস করে।

চিয়াসদ পই, ম্রোদের গো-হত্যা অনুষ্ঠান
থুরাই এই জীবকূলকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে বর্ণমালা সম্বলিত একটি ধর্মীয় গ্রন্থ দান করবেন বলে স্থির করলেন। তখন ম্রোরা জুমে ব্যস্ত। অন্যরা ধর্ম গ্রন্থ পেলেও পেলো না ম্রোরা। কারণ তারা সঠিক স্থ‍ানে পৌঁছুতে অনেকটা দেরি করে ফেলেছে। তখন থুরাই গরুকে নির্দেশ দিলেন গ্রন্থটা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু গরু তাপাদহে পথিমধ্যে গ্রন্থের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। তারপর ঘুম থেকে জেগে ক্ষুধায় খেয়ে ফেললো গ্রন্থটি। ম্রোরা পেলো না তাদের ধর্মগ্রন্থ। bandarban-4

সেই সময় থেকে গরু ম্রোদের কাছে জাতির শত্রু। থুরাই গরুকে অভিশাপ দিলেন এবং বললেন- যতদিন ম্রোরা ধর্মগ্রন্থ না পাবে ততদিন তোমাদের উপর নির্যাতন চলবে।

ম্রো বিশ্বাস অনুযায়ী, এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন একজন মহাশক্তিমান। নাম তার থুরাই। তারা বিশ্বাস করে- পৃথিবীর চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, জীব-জন্তু, গাছ-গাছালি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা থুরাই।

থুরাই দেবতার ধর্মগ্রন্থ বিষয়ক অভিশাপের পর থেকেই ম্রোরা গো-হত্যা করে। কালক্রমে এটি হয়ে ওঠে তাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক অনুষ্ঠান।

বাঁশের একটি খাঁচার মধ্যে বন্দি করে পাড়ার মানুষ এক হয়ে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে গরুকে হত্যা করে। পরে যাওয়ার সময় জিহ্বাটা কেটে লাঠির মাথায় গেঁথে দেয়। এরপর তারা সবাই মিলে সে গরুর মাংস খায়।

কালক্রমে ম্রোরা ‘ক্রামা’ ধর্ম গ্রহণ করার পর গো-হত্যা থেকে তারা অনেকেই সরে এসেছে।

৬ বছর আগে প্রথম সোলারের বৈদ্যুতিক আলো দেখা আদা পাড়ার মানুষ এসব বিশ্বাসে ভর করেই হাজার বছর ধরে জীবন অতিবাহিত করছে।

যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।

থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।

বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন।   খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড।

বান্দরবানের বৈচিত্র্যময় নানা বিষয়ে জানতে নিচের লিংকগুলি দেখুন

বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৩
জেডএম/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।