ডিসেম্বর এলেই বীরাঙ্গনারা আঁতকে ওঠেন। তাদের মনে পড়ে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের পৈশাচিকতা।
সূর্যবানুর বর্ণনা : পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন ঘুরকা গ্রামের এক দিনমজুর কৃষক পরিবারের ঘরে। সাথে ছিলেন মা, বাবা আর ছোট দুই ভাই-বোন। ৩০ এপ্রিল হানাদার বাহিনী রাজাকারদের নিয়ে ঘুরকা গ্রামে অভিযান চালায়। খুঁজতে থাকে মুক্তিবাহিনী। সূর্যবানুর আশ্রয়স্থলে ঢুকে বাড়ির সবার সামনেই তার শ্লীলতাহানি করে।
কোনও এক সকালে বাহাতন বেগম শহরতলীর নিজ গ্রাম রানীগ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ধানগড়া গ্রামে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী গ্রাম থেকে ধরে এনে উন্মুক্ত মাঠে ধর্ষণ করে তাকে।
রাহেলা বেগম বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন রানীগ্রাম ইটভাটায়। রাহেলার কোলে তখন ৫ মাসের সন্তান। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ইটভাটায় ঢুকে তার কোলের সন্তানকে ছুড়ে ফেলে ধর্ষণ করেছে। রাজুবালাকে ধরে এনেছিল ফুলকোচা গ্রাম থেকে। ১০ দিন আটকে রাখা হয়েছিল সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ ক্যাম্পে। প্রতিদিন তার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর এসব বীরাঙ্গনা লোকলজ্জা আর সামাজিকতার ভয়ে মুখ খোলেননি। অনেকের নিজ বাড়িতেও স্থান হয়নি। মুখ লুকিয়ে পালিয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নির্যাতিত নারীদের জন্য খুলেছিলেন নারী পুর্নবাসন কেন্দ্র। নারী পুর্নবাসন কেন্দ্রে সিরাজগঞ্জের ৩০ জনেরও বেশি নির্যাতিত নারীকে উদ্ধার করে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। নির্যাতিত নারীরা আবার ফিরে যান পুরাতন আশ্রয়ে। যে যেখানে পেরেছেন আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে সিরাজগঞ্জের মানবাধিকার সংগঠন উত্তরণ মহিলা সংস্থা তাদের সহায়তা দিচ্ছে।
দীর্ঘদিন মুখ লুকিয়ে থেকে এখন ১৫ জন বীরাঙ্গনা মুখ খুলছেন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের পাশবিক নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করছেন অকপটে, বিচার দাবি করছেন সেসব নরপশুর।
তবে নির্যাতিত এই নারীদের অভিযোগ, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া হলেও তাদের নামে ভাতা বরাদ্দ নেই। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়ও তাদের নাম নেই। বীরাঙ্গনা হাসনা বানুর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান দূরের কথা, দাফনের কাপড় জোগাড় করতেও পরিবারটিকে হাত পাততে হয়েছে।
বীরাঙ্গনা সূর্যবানু, বাহাতন, রাহেলা, কমলা, মাহেলা জানিয়েছেন, তাদের সমাজে স্থান না দিলেও সেদিনের স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন প্রতিষ্ঠিত। তারা বেদনার সঙ্গে বলেছেন, যে স্বাধীনতার জন্য আমরা সম্ভ্রম হারালাম ৩৯ বছরেও তার সুফল পেলাম না। জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে চাই, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদরদের শাস্তির দাবি কি শুধু দাবিই থেকে যাবে? নাকি হানাদার ও তাদের দোসরদের বিচারের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা মিলবে আমাদের সকল আত্মত্যাগের।
বাংলাদেশ সময় ২২৪০, ডিসেম্বর ৮, ২০১০