ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

বঞ্চনার দুষ্টচক্রে আটকাপড়া জীবন!

মফিজুল সাদিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১৬, মে ২১, ২০১৩
বঞ্চনার দুষ্টচক্রে আটকাপড়া জীবন!

ঢাকা: প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন দলিত, হরিজন ও বেদে জনগোষ্ঠীরা। এরা যেন সমাজের বাইরের কেউ! সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে এদের সংখ্যা প্রায় ৬৩টি লাখ; যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ এবং হরিজন ১৫ লাখ।



বহুমাত্রিক বৈষম্যের কারণে প্রায় ৯৬ শতাংশই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করেন।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা সামাজিক বঞ্চনার দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছেন। এ চক্রাকার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিগৃহীত এ সব জনগোষ্ঠী সুইপার, চা-শ্রমিক, মুচি, ধোপা, ডোম, মেথর ইত্যাদি পেশায় সেবা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

জন্ম পরিচয় ও পেশাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে তাদের ওপর  নেতিবাচক মনোভাবের কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। সমাজের এই দলিত জনগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিভাবে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন।

১৯০৫ সাল থেকে ঢাকা পূর্ববঙ্গের রাজধানী হওয়ার পর বাড়তি সুইপার দরকার হলে ভারতের কানপুর, নাগপুর, তেলেগু ও মাদ্রাজ থেকে ‘ভালো’ কাজের কথা বলে এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয় এই সব দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষদের।

যাদের আমরা পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে দেখছি, তারা বর্তমানে  কানপুরী, তেলেগু, ঋষি, কাওরা, বেদে, রবিদাস, পৌণ্ড্র, চা-শ্রমিক, নিকারীসহ প্রায় শতাধিক ক্ষুদ্র সম্প্রদায় হিসেবে এদেশে বসবাস করছেন।

সুজিতা বেদে সাভারের পোড়াবাড়ি ইউনিয়নের ওমরপুর বেদে পাড়ায় বসবাস করেন। উপার্জনের হাতিয়ার বলতে এক জোড়া সাপ ও কিছু তাবিজ।

চার সন্তান নিয়ে সেখানেই বাস করেন তিনি। সাপখেলা দেখিয়ে ও তাবিজ বিক্রি করে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশ টাকা আয় করে ঘরে ফেরেন। এ পেশা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে চান সুজিতা।   মূলধারার জনস্রোতের মানুষ হিসেবে বাঁচতে চান তিনি।

বাংলানিউজকে সুজিতা বলেন, “আমার বাপ-দাদা সগ্গলেই সাপুড়্যা আছিলো। এই কাম থেইক্যা আমার মুক্তি পেতে চায়। ”

তার সন্তানেরা স্কুলে পড়ে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই কামে প্যাটেই ভাত জোটে না। বাচ্চাগো ল্যাখা পড়া সেকামো ক্যামনে!”

সুজিতা বলেন, “সাপ খেলা দেখিয়ে কোনো মতে ১০০ টাকা আয় করোন যায়। কোন সুম যায়, আবার কোন সুম যায় না। কিন্তু তাবিজ আর তেমন করে বিক্রি করা যায় না। কারণ, মানশি (মানুষ) আর এগুলো বিশ্বাস করেনা!”

শুধু বেদে সম্প্রদায়ই নয়, একই অবস্থা হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদেরও। সামাজিকভাবে বঞ্চনার শিকার তারা।  

আরতি রাণী গণকটুলি সিটি কলোনিতে বাস করেন। প্রতিমাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করেন। এই দিয়ে স্বামীহারা আরতি রাণী কোনোমতে সংসার চালান। সিটি কর্পোরেশনের রাস্তাঘাট পরিষ্কার করেন তিনি।
অথচ তিনি অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন বাসায় বসবাস করেন। এদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা একেবারে অবর্ণনীয়!

বাসস্থান: দলিত, বেদে ও হরিজন জনগোষ্ঠীর লোকজন সাধারণত শহরাঞ্চলের সিটি কলোনি, পৌর কলোনি এবং গ্রামাঞ্চলে পুকুরপাড়, রাস্তার ঢালে খড় এবং কাদা দিয়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করেন।

সিটি কলোনির ৮ থেকে ১০ ফুট মাপের একেকটি ঘরে অন্তত ৩টি দলিত পরিবার বাস করে। পরিচয় পেলে এই জনগোষ্ঠীকে কেউ বাসা ভাড়া দেয় না।

বেদে জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে না। পেশাগত কারণে এরা যাযাবরের জীবন-যাপন বেছে নিতে বাধ্য হন।

পেশা ও কর্মসংস্থান: বেকারত্ব এসব জনগোষ্ঠীর অন্যতম সমস্যা। সামাজিকভাবে অস্পৃশ্যতার কারণে অন্য পেশার জন্য তারা দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না। ফলে, আবার পৈত্রিক পেশায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। এদের ৬০ শতাংশই গড়ে প্রতিমাসে তিন থেকে পাঁচহাজার টাকা আয় করেন।

স্বাস্থ্যগত সমস্যা: দলিত জনগোষ্ঠীর বাসস্থান ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা একেবারেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নোংরা পরিবেশের কারণে এই জনগোষ্ঠীর লোকজন নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, পেটের পীড়া ও ত্বকের অসুখে ভুগতে থাকে।

শিক্ষাক্ষেত্র: সাধারণভাবে দলিত, হরিজন ও বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

সম্প্রতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরীর এক গবেষণায় জানা যায়, শুধু লিখতে পড়তে পারা বিবেচনায় এদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৫ শতাংশ।

সাধারণভাবে যেখানে স্কুলে শিশুদের ভর্তির হার ৯০ শতাংশ,  সেখানে দলিত শিশুদের স্কুল ভর্তির হার ১০ শতাংশ। এর মধ্যে  অনেকেই আবার ঝরে পড়ে।

এ সব জনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাছিমা বেগম বলেন, “সমাজে প্রতিনিয়ত এরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সমাজের অন্য সবার মতো এদের সঙ্গে একই আচরণ করা। ”

তিনি বলেন, “এই জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশই নিরক্ষর। এদের প্রতি ঘৃণা ও অবহেলা সমাজে এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে, প্রাথমিকভাবে এরা সহপাঠীদের দিয়ে  আচরণ ও বৈষম্যের শিকার হয়, যা  তাদের স্কুল ছাড়তে বাধ্য করে। সমাজের সব মানুষের উচিত এদের সঙ্গে মানুষ সুলভ আচরণ করা। এদের কারণে আমরা পরিষ্কারের বড়াই করি। ”

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৮ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৩
এমআইএস/ সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।