ঢাকা, শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৬ মে ২০২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সীতেশ বাবু, ভল্লুক ও চিড়িয়াখানা

তমাল ফেরদৌস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৪৯, ডিসেম্বর ৯, ২০১০
সীতেশ বাবু, ভল্লুক ও চিড়িয়াখানা

বিরল প্রজাতির সাদা বাঘ দেখার লোভ অনেকেরই আছে। আমাদের দেশে সচরাচর দেখা যায় ডোরা কাটা বাঘ, মেছো বাঘ কিন্তু সাদা বাঘ দেখা ভাগ্যের ব্যাপার।

একমাত্র সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানায় গেলে দেখা যায় সাদা বাঘ। এটি সীতেশ রঞ্জন দেবের মিনি চিড়িয়াখানা নামে দেশে-বিদেশে পরিচিত। যদিও বৃহত্তর সিলেটের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর ঘেঁষে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা একমাত্র চিড়িয়াখানাটি আর্থিক সংকটের কারণে সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। চিড়িয়াখানটিতে প্রাণীদের স্থান সংকুলন না হওয়ায় স্থান পরিবর্তন করে হাইল হাওরের ফিশারি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিদিন দেশের নানা জায়গা থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরের এই চিড়িয়াখানাটি দেখতে। বছর তিনেক আগে এই চিড়িয়াখানায় অজগরের ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটানো থেকে শুরু করে দেশের একমাত্র সাদা বাঘ (হোয়াইট টাইগার) আর বিরল প্রজাতির ভল্লুক সংগ্রহ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। চিড়িয়াখানায় একের পর এক নতুন প্রাণী এলেও আর্থিক অনটনের কারণে এটি চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিড়িয়াখানার মালিক শৌখিন প্রাণী সংরক সীতেশ রঞ্জন দেব।

চিড়িয়াখানায় চার-পাঁচজন পরিচর্যাকারী ছিল। বর্তমানে মাত্র দুজন দেখাশোনা করছেন। সীতেশ বাবু জানিয়েছেন, আগে প্রতিদিন প্রাণীদের খাবারের জন্য ১ থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ হতো। এখন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আগে একটি নতুন প্রাণী এলে যতটা খুশি হতেন এখন আর্থিক কারণে তার আগ্রহে অনেকটা ভাটা পড়েছে।

দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সীতেশ বাবু ব্যক্তি উদ্যোগে তার চিড়িয়াখানার প্রাণীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে তার দুর্লভ সংগ্রহ দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক এসেছেন। সীতেশ বাবুর এই চিড়িয়াখানাকে একরকম প্রাণীর সেবাশ্রম বলা যেতে পারে। জেলার লাউয়াছড়া, কালেঙ্গাসহ আশপাশের জঙ্গলের বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু লোকালয়ে ছুটে এলে সেগুলোকে উদ্ধার করে সেবাশুশ্রƒষা করে আবার জঙ্গলে অবমুক্ত করেন।

শিকার করতে গিয়ে ভল্লুকের থাবায় সীতেশ বাবু হারিয়েছেন তার একটি চোখ। তবু তার চিড়িয়াখানায় রয়েছে বিরল প্রজাতির দুটি ভল্লুক। অবসরে তাদের নিয়ে খেলা করেন। বর্তমানে তার চিড়িয়াখানায় বিলুপ্ত প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে একটি সাদা বাঘ, দুটি সোনালি বাঘ, পাহাড়ি বক, নিশি বক, সোনালি কচ্ছপ, হনুমান, লজ্জাবতী বানর, অজগর, উড়ন্ত কাঠবিড়ালী, মায়াহরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ প্রায় দেড়শ প্রজাতির জীবজন্তু। তার মতে, সাদা বাঘটি বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। কিছুদিন আগে একটি বিরল প্রজাতির কিং কোবরা এনে সেবাশুশ্রƒষা করে ছেড়ে দিয়েছেন লাউয়াছড়ার গভীর বনে।

তবে বর্তমানে এসব প্রাণী নিয়ে অনেকটা বিমর্ষ থাকেন সীতেশ দেব। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এত বিপুল সংখ্যক প্রাণীর খাবার সংগ্রহ করা রীতিমতো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে তার জন্য।   যদিও তার জীবনের মূল আনন্দই হচ্ছে তার সযতেœ আগলে রাখা এসব পশুপাখি। কষ্ট হলেও এসব জীবজন্তুর জন্য তার ভালোবাসা অপরিসীম। চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা গেছে, খাঁচার ভালুক, বাঘ, সাপ আর পাখিগুলো খাঁচায় নেই। তাদের বাইরে বের করে এনে নিজ হাতে মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। প্রবেশ ফি না থাকায় প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী তার চিড়িয়াখানায় এসে পশুপাখিদের সাথে তাদের ছেলেমেয়েদের পরিচয় করিয়ে দিতে আসেন।

সীতেশ বাবুর ভল্লুকের গল্প

পুরো নাম সীতেশ রঞ্জন দেব। সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়স। তিনি শিকারি সীতেশ বাবু নাম সর্বধিক পরিচিত। বিভিন্ন সময় সরকারি টোকেন নিয়ে সিলেটের বনে জঙ্গলে শিকার করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সবার কাছে প্রাণী সংরণবিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। শিকার করতে করতে একসময় তিনি নিজে চিড়িয়াখানা নির্মাণ করেন। শ্রীমঙ্গল শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডে ছিল তার চিড়িয়াখানা। বর্তমানে হাইল হাওরঘেঁষা নিজের জমিতে স্থানান্তর করেছেন এটি। ১৯৯১ সালে তার জীবনে ঘটে ভয়ংকর ঘটনা। সেদিন তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। ভল্লুকের থাবায় তার ডান চোখ এবং মুখের একটি অংশ হারান।

সীতেশ রঞ্জন দেব সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে : শীতকাল। চারদিক ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ছিল। ফসল বিনষ্টকারী বন্য শূকর তাড়াতে পাথরখোলা চা বাগান থেকে আমাকে ডাকা হয়েছে। শিকারের নেশা রক্তে। শ্রীমঙ্গল শহরের সীমান্তঘেঁষা চা বাগানটির উদ্দেশ্যে রওনা দিই। একে শীতের দিন, তার ওপর ঘন বনজঙ্গল থাকায় দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো নেই তেমন। আমি দোনলা বন্দুক হাতে সতর্কতার সাথে সামনে এগুতে লাগলাম। ভয় ও শীত দুটোই আমার মাঝে কাজ করছে। অনেকবার এই পাথরখোলা চা বাগানের জঙ্গলে এসেছি। কিন্তু আজ পরিবেশটা আমার অনুকূলে মনে হচ্ছে না। আমি এগুচ্ছি শন, লতা-গুল্ম, ঘন পাতার সারি সারি পাতাকে একহাত দিয়ে সরিয়ে। হঠাৎ আমার পায়ে নরম তুলতুলে কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করলাম। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি আমার সামনে একটি ভল্লুক। শরীরের রক্ত একবারে জমাট বাঁধার উপক্রম। ভল্লুকটির উচ্চতা আনুমানিক ৮ ফুট। কালো রঙের এই ভল্লুকটির বুকে সাদা ‘ভি’ আকৃতির দাগ স্পষ্ট। পরে জেনেছি ভল্লুকটি ইন্ডিয়ান ‘ব্ল্যাক বিয়ার’। আমার পা যখন তার ওপর পড়েছিল তখন সে নিগূঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। পায়ের চাপে তার ঘুম ভাঙাতে সে বিরক্ত হয়ে চারদিকে বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছিল। কী করব স্থির করতে পারছিলাম না। অনেক ভেবে আক্রমণ করার চিন্তা করলাম। যখন গুলি করার করার জন্য বন্দুক উঠাতে গেলাম তখনই সে আমার ডান হাতে থাবা মারলো। আমি তার থাবায় ব্যালেন্স রাখতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। সাথে সাথেই আবার উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার প্রচ- জোরে আমার ডান গালে থাবা মারলো। থাবার আঘাতে আমার মুখের ডানপাশের মাংস ঝুলে পড়লো। রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরুতে লাগলো। সেই সঙ্গে ডান চোখ গলে গেলো। ভল্লুকটি যখন আবার আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে এল তখন বন্দুক দিয়ে তার বুকের বাঁ পাশে গুলি করলাম। কিছুণের মধ্যেই ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। আমি তখন এক হাত দিয়ে মুখের ডানপাশের ঝুলে পড়া মাংস চেপে ধরে জিপে করে বাসায় ফিরলাম। প্রথমে জেলা শহর মৌলভীবাজারে চিকিৎসা নিই। পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ২৪ দিন এবং সিএমএইচ-এ তিন মাসের মতো চিকিৎসা নিয়েছি। ওই সময় আমার শরীরে ২৯ ব্যাগ রক্ত লেগেছিল। শরীরের ওজন কমে ২০ কেজি হয়েছিল। পরে মুখের ডানপাশটি প্ল্যাস্টিক সার্জারি করার জন্য কোলকাতার  মেট্রোপলিটন কিনিকে দু বারে তিন মাস চিকিৎসাধীন ছিলাম। তখন আমার ডান হাতের মাংস নিয়ে চোয়ালে লাগানো হয়েছিল। বাংলাদেশ ও কোলকাতায় চিকিৎসা নিতে আমার খরচ হয়েছিল প্রায় ৫ লাখ টাকা। বর্তমানে ভালো থাকলেও গ্রীষ্মকালে আঘাত পাওয়া স্থানে ব্যথা অনুভব করি।

সীতেশ বাবু শেষ কথাটি বললেন, জীবজন্তুর সেবা করে ও মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আজীবন কাজ করে যেতে চাই।

বাংলাদেশ সময় ১৩৩৫, ডিসেম্বর ০৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।