ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

রাতের রুটির কারিগর শাহজাহান

রহমত উল্যাহ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪:৪৬, মে ২৩, ২০১৩
রাতের রুটির কারিগর শাহজাহান

ঢাকা: ‘মামা, সারারাত বড় বড় রুটি তৈরি করি। মশার কামড় খেয়ে রাত মানুষকে সামান্য রুটি খাইয়ে সেবা দি।

আমার রুটির অনেক সুনাম।

এটি খেতে বড় বড় মানুষ -এমপি, সরকারি-বেসরকারি বড় কর্তা ব্যক্তিরা আসে। সুযোগ ও পুঁজি থাকলে আমার রুটির জাদু সারাদেশের মানুষকে দেখাতাম। তখন দেখতেন আমি রাতারাতি হিরো হয়ে যেতাম। ’

কথাগুলো রাজধানীর পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাতে রাতে আটার রুটি কারিগর মো. শাহজাহান মিয়ার।   শাহজাহানের বাড়ি পটুয়াখালী। গত ২০ বছর আগে কাজের খোঁজে ঢাকা এসে রুটির দোকানে ১০ টাকায় কাজ শুরু করেন। নরসিংদীর ‍হাজী দেওয়ান আলী দোকানের রুটি কারিগর শাহজাহানের বেতন এখন ৫ হাজার ৫শ টাকা।

শাহজাহান বলেন,‘‘এখানে প্রায় ৩৫ বছর ধরে করে রুটির দোকান করে আসছে নরসিংদীর হাজী দেওয়ান আলী। দোকান করে তিনি ছেলেমেয়ে মানুষ করে বিয়ে দিয়েছেন এবং হজ করেছেন। ”

আগে সারাদিন দোকান খোলা রাখা গেলেও এখন আর যায় ন। গত ৫-৭ বছর ধরে আছরের নামাজের পর থেকে ভোর ছ’টা পর্যন্ত খোলা থাকে দেওয়ান হাজীর রুটির দোকান। পুলিশ ও মাদক খোরদের চাঁদাবাজির জন্য দিনে দোকান চালানো যায় না। প্রতি রাতে পুলিশকে ৫০-৬০ টাকা না দিলে দোকান করতে দেয় না বলে তিনি ‍অভিযোগ তার।

তিনি বলেন,‘‘ প্রতি রাতে ১৫-২০ কেজি আটার রুটি, ভাজি ও গুড় বিক্রি হয়। ক্রেতা রিক্সাওয়ালা থেকে এমপি পর্যন্ত। প্রতি রুটি আট টাকা, ভাজি পাঁচ টাকা, গুড় দু’ টাকা। আমি একলা সারাদিন রুটি তৈরি করি। তৈরি করে রুটি দিয়েও কুলোয় না। আমার রুটি এত সুস্বাদু’র কারণে পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে রাতের দেওয়ান হাজীর রুটি খেতে সবাই চলে আসে। ’

যে টাকা আয় হয় তাতে সংসার চলে কিনা এমন প্রশ্নে শাহজাহান বলেন, “দু’ ছেলে, এক মেয়ে। পরিবার পটুয়াখালী থাকে। কোনো মতে এ টাকা দিয়ে সংসার চলে যায়। প্রথম ওস্তাদ (হাজী দেওয়ান) থেকে কাম শিখছি। এখন ওস্তাদ থেকেও আমার তৈরি রুটি ভালো হয়। পুঁজি থাকলে অনেক আগে বড় একটি ঐতিহ্যবাহী রুটির দোকান দিতাম। ”

তিনি বলেন,‘‘আমার দোকানে রুটি খেয়ে অনেক জনের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে। যাদের এখন দেখি গাড়ি দৌড়ে সামনে দিয়ে যায়। অনেকের কাছে বাকি টাকা পাই। ” আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “তাদের ভাগ্য ফিরলেও আমার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। । ”

চাঁদাবাজ ও পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন,‘‘ রাত জেগে সামান্য এ ব্যবসা করি। কখনো ডাইল খোর (মাদকসেবী), কখনো পুলিশি হয়রানি কপালে জোটে। মাদকসেবীরা খেয়ে টাকা না দিয়ে চলে যায়। ”

দোকান বসালে প্রতি রাতে পুলিশকে দিতে হয় ৫০-৬০ টাকা। এ ব্যবসায় চাঁদা দেয়ায় বিষয়ে তিনি হতবাক ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। ব্যবসার সুযোগ চেয়ে শাহজাহান বলেন,‘ প্রতি রাতে ১৫-১৬ কেজি আঠার রুটি তৈরিতে যে পরিমাণ হাত ঘুরাতে হয় এভাবে আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরতো তাহলে আজ ঢাকায় দু’টো বাড়ি থাকতো। কোন লোন বা সাহায্য পাওয়া যেত তাহলে ওস্তাদ থেকে আলাদা করে একটি রুটির দোকান দিতাম। ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া ও স্ত্রীকে ঢাকায় এনে রাখতে পারতাম। ”

অনেকে আশ্বাস দিলেও কেউ কথা রাখেনি বলে আক্ষেপ শাহজাহানের। তার অভিমানমিশ্রিতি মন্তব্য, “আমার রুটি বিখ্যাত হলেও খাবার পর সবাই ভুলে যায়। আপনাদের মতো অনেকেই কইছে অনেক কিছু করবে। কই সবই শুভংকরের ফাঁকি রে ভাই। ”

রুটি খেতে আসা রিক্সাচালক মজিদ মিয়া জানালেন, “গত ২০ বছর ধরে হাজী দেওয়ানের রুটি খাই। এ রুটিতে জাদু আছে। একটি খেলে পেট ভরে যায়। বাসায় যতই খাই দেওয়ানের রুটি না খেলে ক্ষুধা থেকে যায়। ”

মজিদ মিয়ার মতো শ্যাম বাজার থেকে রুটি খেতে আসা মুদি ব্যবসায়ী সোলেমান বলেন, “প্রতি রাতে দেওয়ানের রুটি না খেলে ঘুম হয় না। এত বছর ধরে দেওয়ানের রুটি স্বাদ যেমন ছিল তেমনই আছে। ”

তবে চাঁদাবাজরা (পুলিশ ও নেশাখোর) ক্ষতি না করলে অনেক আগেই ব্যবসা বড় হতো ও স্থায়ী একটি দোকান হত বলে মত তার।

ঢাকা শহরে ফুটপাতে এভাবে হাজার হাজার শাহজাহান আছে যাদের ভাগ্য ফেরে না। তাদের খোঁজও কেউ রাখে না। একটু খানি সহযোগিতা ফেলে এসব শাহজাহান দেশে হয়ে উঠবে বড় ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৪১ ঘণ্টা, ২৩ মে, ২০১৩
আরইউ/সম্পাদনা: শরিফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, eic@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।