রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।
বান্দরবান থেকে ফিরে: সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা। পাহাড়ের সবুজাভ স্বচ্ছ আলো কিছুটা ক্ষীণ হয়ে ধূসর রঙে রূপ নিয়েছে। ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যা। সারাদিনের কাজ সেরে রেমাক্রি নৌকা ঘাটে একটু একটু করে বাড়ছে কর্মজীবী মানুষের আনাগোনা। খানিক পরই আড্ডা জমতে শুরু করবে।
বান্দরবান সদর থেকে ৮১ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ বাসে পাড়ি দিয়ে থানছি এসেছি সাড়ে চার ঘণ্টায়। সেখান থেকে কখনো সাঙ্গুর বুকে নৌকায় ভেসে, কখনোবা সাঙ্গু তীরের পাথুরে পাড় ধরে হেঁটে আরো ছ’ঘণ্টার পথ মাড়িয়ে পৌঁছেছি রেমাক্রি।
এখানে পাহাড়ি জনপদ রেমাক্রিকে পশ্চিমে রেখে উত্তরে এগিয়েছে সাঙ্গু। পূর্বে এ অঞ্চলের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ঝরণা নাপাকূম থেকে গাড়িয়ে নেমে রেমাক্রী বাজারের উল্টো দিকে সাঙ্গুতে নামা ঝিরিটি এখন শুকনো।
শুকনো মৌসুম হওয়ায় সাঙ্গুতেও পানি কম। রেমাক্রি ঘাটের পাশে বেশ ক’টি দোকান। কোনোটিকে দোকান না বলে বাসঘরও বলা যায়। কারণ, দু’টি কাজই চলে পাশাপাশি। কেউ জুম থেকে, কেউ বাজার-সদাই করে, কেউ মাছ ধরে, কেউবা সারাদিন নৌকা চালিয়ে ফিরছে ঘাটে। এ সময়টুকু শুধুই অবসর আর আড্ডার। মুখে পান দিয়ে, বার্মিজ চুরুটে একটু তামাক লাগিয়ে বা দেশি পানীয়ে বুঁদ হয়ে আড্ডা-হৈহুল্লোড়ে রাতের প্রথম প্রহরটা কেটে যাবে এখানেই।
এরই মধ্যে নৈশভোজের পর্বটাও সেরে ফেলবেন কেউ কেউ। রাতের শেষ প্রহরে যার জুমে যাওয়ার তাড়া আছে তিনি হয়তো ঘুমিয়েই পড়বেন ইত্যবসরে। পাহাড়ে পাহাড়ে এখন জুমক্ষেত প্রস্তুতের মৌসুম।
ঘাটে চলছে তুমুল আড্ডা-খোশগল্প। দূরে পাহাড় জ্বলছে জুমের আগুনে। সাঙ্গুর স্বচ্ছ জলে তারই প্রতিচ্ছায়া। মাছ ও ব্যাঙ শিকারে বের হয়েছে পাহাড়ি শিশুরা। হাতে হাতে মোমবাতি, টর্চ।
থেমে থেমে বাসাতে ভেসে আসছে তক্ষকের ডাক। ঘাট থেকে একটু সামনে এগুলেই সুনশান নিরবতা।
রাতের রেমাক্রি যেন আমাদের প্রকৃতির নীরব ডাকে হাতছানি দিলো। আলোকচিত্রী নূর সারাক্ষণ সঙ্গে রাখা ক্যামেরাটা ঠিকঠাক দেখে নিলেন। তানজিলের মোবাইল ব্যাটারির তৈরি চার্জার লাইট সঙ্গে। গাইড মংকে নিয়ে আমরা রাতে রেমাক্রি ঘুরে দেখার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। কেউ খুব বেশি নিষেধও করলো না। তবু একটু একটু ভয় নিয়ে বের হলাম।
রেমাক্রির প্রাক্তন চেয়ারম্যান মং ফু অং ও সুমন দা আমাদের ভ্রমণ সীমা বলে দিলেন। বেরিয়ে পড়লাম আমরা ক’জন।
পুরো নদীর কোল জুড়ে ছোট ছোট পাথর বিছানো। একটু দূরেই লম্বা লম্বা শনের ঘাস। এর মাঝ দিয়েই রাতের আঁধারে হাঁটছি আমরা। হাতে লাইটের পাশাপাশি রয়েছে লম্বা বাঁশ। বন-জঙ্গল সরাতে আর পোকামাকড় তাড়াতে এই ব্যবস্থা। আর মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে মেখে নিয়েছি ওডোমাস ক্রিম। সুতরাং অনেকটাই নিশ্চিন্ত। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম সবাই।
আমাদের প্রথম গন্তব্য জুমজ্বলা এক পাহাড়ের পাদদেশ। মিনিট দশেক হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু ধারণা ভুল হতে সময় লাগলো না। অনেকটা ছোটবেলার সেই সামনে দেখা যাচ্ছে ঘরবাড়ি- ওখানেই আমরা যাবো। অথচ দু’ঘণ্টায়ও দেখা যেতো, আমরা সেখানে পৌঁছুতে পারছি না।
পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এক ঘণ্টা পর পৌঁছুলাম সেই পাহাড়ের কাছে। প্রথমেই আমরা অতি স্বার্থপরের মতো নিচ থেকে উপর পর্যন্ত লাইন ধরে জ্বলা পাহাড় এবং তার প্রতিচ্ছবি হিসেবে সাঙ্গুর আগুনজ্বলা জলের সৌন্দর্য উপভোগে মেতে উঠলাম। নূর ভাই কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়ে নিলেন। কিন্তু সে সৌন্দর্য বিষাদে পরিণত হতে বেশি সময় লাগলো না।
মং বললো- এখান থেকে তিন দিন আগে এই পাহাড়ের অপর পাশে জুমে আগুন দিতে গিয়ে মারা গেছে ষোড়শী এক কিশোরী। চারপাশের পাহাড়ি গাছ কেটে ফাঁকা করে আগুন দিয়ে সে আর বেরুতে পারেনি।
এমন দুর্ঘটনা প্রায়শই ঘটে পাহাড়ে। কখনো আগুন পোড়ায়, কখনো সাপে কাটে জুমচাষীকে।
মন খারাপ করে রেমাক্রি বাজারের ফিরতি পথ ধরলাম। কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম- একদল মানুষ সাঙ্গুর জল বেয়ে টর্চের আলো জ্বালিয়ে আমাদের দিকে আসছে। একটু ভয় পেলাম। এই নির্জন পাহাড়ে রাতে কারা এগিয়ে আসছে!
কিন্তু আগন্তুকরা কাছে আসতেই ভয় কেটে গেল। পড়তে হলো লজ্জায়! এ লজ্জা, অন্যের লজ্জা দেখে লজ্জা! একদল মানুষ আসলে পাঁচ-ছয় জন শিশু। রাতে তারা বেরিয়েছে মাছ আর ব্যাঙ ধরতে। হাতে সবার মাছ ধরা বল্লম। পিঠে ঝাঁকি। আমাদের দেখে প্রথমে দৌড় দিলো। কিছুতেই আমরা কথা বলতে বা ছবি তুলতে পারলাম না। অবশেষে মংয়ের কথা অনুযায়ী তারা একটা ছবি তুলতে রাজি হলো।
কিছুক্ষণ পরেই বাজারে পৌঁছুলাম। আমাদের খাবার রেডি। সাঙ্গুর জলে হাত ধুয়ে বসে পড়লাম খেতে। দেশি মুরগি, সাঙ্গুর রুই মাছ ভাজি, আলু ভাজি আর ডাল। এমন পাহাড়ি পরিবেশে এই খাবারের কোনো তুলনা খুঁজে পেলাম না। জুমের ভাতের স্বাদ শুধু খেয়েই বোঝা সম্ভব।
খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে বসে পড়লাম চেয়ারম্যানের বার্মিজ পণ্যে ঠাসা দোকানে। পাশের দোকানে ততক্ষণ অনেকে পাহাড়ি পানীয়ে বুঁদ। ভেসে আসছে হাসির অট্টরোল। চেয়ারম্যান মং সিং আমাদের সঙ্গে কথা বললেন দেশ, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকার এই জনপ্রতিনিধির প্রজ্ঞা বিস্ময় জাগানিয়াই বটে।
এবার রাতে থাকার পালা। সুমন দা এসে জানালেন- থাকতে হবে চেয়ারম্যানের বাংলোতে। সেটা পাহাড়ের উপর। কাঠের তৈরি সুন্দর একটি বাংলো। দুটি রুম। একেক রুমে থাকা যাবে কমপক্ষে ১০ জন করে। সামনে আবার বড় একটি বারান্দা। এখান থেকে রেমাক্রির অনেকটাই দেখা যায়।
দেখতে দেখতে রাত এগারোটা বাজলো। চারদিকে শুনসান নিরবতা। পাহাড়ি পোকামাকড়ের বিচিত্র ডাক। কিছুক্ষণ পর পর ডাকছে তক্ষককককক......তক্ষককককক......। এই পরিবেশে একটু ভয়ই লাগে।
হঠাৎ নজর পড়লো আকাশের দিকে। শহরে থাকতে থাকতে তো আমরা ভুলে গেছি আকাশ কেমন। রাতের আকাশ যে মানুষের আশ্রয় হতে পারে, কত বিচিত্র ভাবনার উদ্রেক করতে পারে, কত বিশাল হতে পারে তা যেন বহুদিন পর আরেকবার উপভোগ করলাম। এতো তারা আকাশে! রেমাক্রির রাতের আকাশ যেন সৌন্দর্যপিপাসু মনে গভীর দাগ কেটে যায়।
যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।
থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।
বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন। খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড। এমন একজন গাইড হলেন- মং মারমা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৭-৪১১০১৩ নম্বরে। ফোন করে যদি বন্ধ পান তাহলে বুঝবেন থানচিতে নেই তিনি। হয়তো কারো গাইড হয়ে গেছেন তিন্দু, রেমাক্রি বা বিজয় কেওক্রাডংয়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে তাকে বুক করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৩
জেডএম/