রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।
বান্দরবান থেকে ফিরে: শূন্যে ঝুলে আছে মুরগি! তাও আবার সম্ভব নাকি!! মাঝে মাঝে না হয় একটু উড়তে পারে কিন্তু তাই বলে শূন্যে ঝোলা!!!
আমরা তখন ছোটমোদক মিশনারিজ স্কুল থেকে ফিরছি। পথে হঠাৎ চোখ আটকে গেল তুলনামূলক নিচু এক মাচাংঘরে। ঘরের সামনে গোলাকার কয়েকটি ঝাঁপি ঝুলছে। এভাবে ঝুলতে দেখে আগ্রহ জাগলো কারণ জানার। একটু এগিয়ে গিয়ে তো চোখ ছানাবড়া! চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম- এর মধ্যে মুরগি!!
মুরগিগুলোর বেশ চাকচিক্যময় চেহারা। স্বাস্থ্যবানও বটে। পাহাড়ের প্রকৃতির মতোই সজীব তারা। আমাদের দেখে একটুও পাত্তা দিল না। একেবারে ভাবলেশহীন! ভাবখানা এমন যে, তোমরা এসেছ তো আমার কি? তবে অন্যভাবে বলা যায় পাহাড়ের মানুষগুলোর মতো অল্প সময়েই হয়তো তারা আমাদের আপন মানুষই ভাবলো।
এটা মূলত তাদের ডিম পাড়া ও তা দেওয়ার জায়গা। রয়েছে আলাদা থাকার ঘরও। তবে অনেক মুরগি আবার এখানেই রাত্রিযাপন করে।
মুরগির ঝুলন্ত ঘরের অন্যতম কারণ সাপ, বেজি, খাটাশ ও শিয়ালের হাত থেকে নিরাপদে থাকা। এভাবে রাখলে এসব মাংশাসী জন্তু থেকে নিরাপদ থাকে মুরগীগুলো।
মুরগি ও শূকর ছাড়া অতিথি আপ্যায়ন চলে না পাহাড়িদের। বিয়েতে বরপক্ষকে কনের বাড়ি নিয়ে যেতে হয় ৭০-৯০টি মুরগি। আর কনেপক্ষ যোগাড় করে ৬০-৮০টি মুরগি। তবে মজার ব্যাপার হলো- বরপক্ষ যে মুরগি আনে তাদের কিন্তু তা খেতে দেওয়া হয় না। কারণ সেগুলো শুধুই কনে পক্ষের জন্য। আর বাড়িতে অতিথি এলে শূকর তো রয়েছেই। এছাড়া বিয়েতে মুরগি বিশেষ একটি কাজে ব্যবহৃত হয়। মারমা সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে তাদের অজ্ঞাতে দু’পক্ষের বাবা-মা বসেন মেয়ের বাড়ি। সেখানে একটি মোরগ হত্যা করা হয়। তারপর মোরগটির জিহ্বা ছিঁড়ে নিয়ে সেখানে একটি বিশেষ স্থান লক্ষ্য করে ভবিষ্যৎ শুভাশুভ নির্ধারণ করা হয়।
বরপক্ষ আত্মীয়ের কাছে একটি করে মোরগসহ বিয়ের আমন্ত্রণপত্র পাঠায়। যদিও এ প্রথার চল পড়ে আসছে এখন।
এছাড়া চাকমা সমাজেও নব দম্পতির শুভ-অশুভ নির্ণয় করতে মুরগির বিভিন্ন অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হয়।
এসব কারণে পাহাড়ের প্রত্যেক বাড়িতে এ দু’টি প্রাণী দেখা যায়। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি টিকা না পাওয়ার কারণে প্রতিবছর প্রচুর মুরগি নানা অসুখে মারা যায়।
তাদের দাবি, দেশের অন্য জায়গায় যে পরিমাণ টিকা দেওয়া হয় তার অর্ধেকও যদি এই প্রত্যন্ত পাহাড়ে পৌঁছে তাহলে বছরে আরও বেশি মুরগি উৎপাদন করতে পারবে তারা। আর মুরগির যথেষ্ট চাহিদা থাকায় অথনৈতিকভাবেও কিছুটা সচ্ছল হবে পাহাড়িরা।
যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।
থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।
বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন। খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড। এমন একজন গাইড হলেন- মং মারমা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৭-৪১১০১৩ নম্বরে। ফোন করে যদি বন্ধ পান তাহলে বুঝবেন থানচিতে নেই তিনি। হয়তো কারো গাইড হয়ে গেছেন তিন্দু, রেমাক্রি বা বিজয় কেওক্রাডংয়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে তাকে বুক করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৮ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৩
এমএম/জেডএম