ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পাহাড়ের প্রৌঢ়: বয়সের ভাঁজে ক্লান্তিহীন কর্মস্পৃহা

আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৪৩, মে ৩১, ২০১৩
পাহাড়ের প্রৌঢ়: বয়সের ভাঁজে ক্লান্তিহীন কর্মস্পৃহা

রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।

পাহাড়ের কোল বেয়ে বঙ্গোপসাগর পানে ছুটে চলা সাঙ্গু-মাতামুহুরি অন্যরকম এক আবহ যোগ করেছে এ জেলার সৌন্দর্যে। আকর্ষণ আরো বাড়িয়েছে চিম্বুক ও বগা লেক, ঋজুক ঝরণা, শৈল প্রপাত। পাহাড়ের আদরে বসে শরীরে মেঘ মাখার বিরল সুযোগও হরহামেশা পাওয়া যায় বান্দরবানে।

এখানকার মানুষগুলোও যেন প্রকৃতির মতোই উদার, কর্মঠ। পশু-পাখিগুলোর জীবনযাপন পদ্ধতি আর আচরণও যেন সমতলের চেয়ে অনেকটাই ‍আলাদা। ১১ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ছাড়াও বাংলাভাষীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে পাহাড়ময় বান্দরবান জেলায়। সম্প্রতি বান্দরবান ঘুরে এসেছেন বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম। সঙ্গে ছিলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম

বান্দরবান থেকে ফিরে:  মধ্যদুপুর। বৈশাখের প্রখর রোদ। গাছে ঝুলছে থোকায় থোকায় ছোট ছোট আম। নিচে একটু ছায়া। সেখানে বসে সাইনা ম্রো। বয়স ৭১। পাশে একটি থুরং (পাহাড়ি ঝুড়ি)। তার মধ্যে পাহাড়ি ছোট কচুরমুখি। মুখি পরিষ্কার করে রাখছেন থুরংয়ে।

নিবিষ্ট মনে কাজ করছিলেন সাইনা। ছবি তুলতে চাওয়ায় মুখ তুলে তাকালেন। জানতে চাইলে জানালেন বয়সও।
এতো বয়সে কাজ করতে ভালো লাগে? –উত্তরে যে ভঙ্গীতে মাথা নাড়েন তাতে দ্বিধাহীন সম্মতির ব্যাপারটিই বেশ ফুটে ওঠে।

উ লা চিং, মালারুং ত্রিপুরা, খুমাচিং ম্রো, দংকই মারমা, আদা ম্রো, তকরা ম্রো- সবারই বয়স ৬৫ থেকে ৮৩’র মধ্যে। শরীরের  পরতে পরতে বয়সের ভাঁজ। মাথার কাচাপাকা চুলে কাচারই আধিক্য। বয়স তাদের ঘরের চার দেয়ালে আটকে রাখেনি। বেশি পরিশ্রমের কাজ হয়তো করতে পারেন না, তবে কাজ করেন নিয়মিত, আপনমনে। টানা কাজের ক্লান্তির ছাপও নেই কারো  চোখেমুখে।

বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ১২০ কি.মি. দূরে থানচির ছোটমোদকে আমরা। বান্দরবান থেকে সাড়ে চার ঘণ্টায় ৮১ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পড়ি দিয়ে থানচি। সেখান থেকে ঘণ্টা আটেক সাঙ্গুর  বুক বেয়ে রেমাক্রি। সেখ‍ানে জুমজ্বলা রাতের সাক্ষী হয়ে এখন ছোটমোদক বাজারে।

সাইনা ম্রো বা মুরংয়ের মতো বৃদ্ধা-বৃদ্ধ দেখা গেলো আরো কয়েকজন। সবাই কাজে ব্যস্ত।

উ লা চিংয়ের বয়স ৮৩ বছর। ছোটমোদক স্কুলের কাছেই তার ঘর। বাড়ির সামনে এক চিলতে জায়গা বাঁশের ঘের দেওয়া।

ভেতরে আম-কমলার চারা। নিজের লাগানো চারাগুলো রক্ষা আর পরিচর্যায় নিজেই ঘের বাঁধছেন নতুন করে।

এই বয়সেও এমন কর্মতৎপর? –এমন বিস্ময়ের জবাবে অকপটে জানান, নিজের কাজ নিজে করতে ভালোবাসেন তিনি। পরনির্ভরশীলতা পছন্দ নয়।

বাজারঘেঁষা নদীতে কেউ গোসল করছে, কেউ আয়োজন করছে মাছ ধরার, কেউ তুলছে শামুক, ঝিনুক। কাঠুরেরা কাঠ বহনে ব্যস্ত। ভেলায় চড়ে ভেসে চলেছে রিজার্ভ ফরেস্টের বাঁশ।

এমন বিচিত্র জীবনচিত্র দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছুলাম খ্যামরাই পাড়া।

ঢাকা থেকে তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে কেনা ডিম, পেঁয়াজ, আলু আর তেলে দুপুরের ভোজন খ্যামরাই কারবারির বাড়িতে। তার স্ত্রী বুরফি ত্রিপুরা। পরিবারে ছেলে-বউ, নাতি-পুতি।

তাদের নিয়েই ষাটোর্ধ বয়সে বেশ আছেন তারা। সময় কাটে নাতি-পুতি আর সিডির মাধ্যমে বার্মিজ বা বাংলা সিনেমায়।

এর একটু দূরেই বাড়ি রিনাই ত্রিপুরার। বয়স ৭৭। খুব মন খারাপ করে বসে আছেন তিনি ঘরের পাশে ঘরেরই ছায়ায়। কাছে যেতেই একটু মুচকি হাসলেন।

হাতে ষোলো প্যাঁচের ঐতিহ্যবাহী জাওস বা কুঁচিধাড়ু। কানের ছিদ্র অতিশয় বড় হয়ে যাওয়ায় দুল পরতে পারেন না। যদিও গলায় রয়েছে প্রায় শত প্যাঁচের কয়েক হাজার পুঁতির তৈরি মালা ‘লক’।

তবে এগুলোর কোনোটিই তারা বানাতে পারেন না। ডিজাইন বলে দিয়ে বানিয়ে আনেন দূরবর্তী স্যাকরাদের কাছে থেকে। পরিবারে তার রয়েছে শুধু ছেলে-বউ। তারা গেছে জুমে। তাই এভাবে প্রকৃতিকে সঙ্গ দিয়ে কাটছে তার তপ্ত দুপুর।

এখান থেকে তিন বাড়ি পর রিসাই ত্রিপুরার বাড়ি। বয়স ৮২ বছর। গলায় পুঁতির মালা, কানের উপরের অংশে নলের তৈরি নাদং, পাতায় রুপোর কজফুল।

১০ হাত বাই ৮ হাত ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে অবাক চোখে শুধু চেয়ে রইলেন আমাদের দিকে। মুখ খুললেন না। তার মধ্যবয়সী ছেলে জানালেন- তাদের একবেলা খেয়ে দিন কাটানোর কষ্টের কথা। চাইলেন সরকারি সাহায্যও।

এই পাহাড়ি জনপদে এই প্রথম কেউ কষ্টের কথা জানালো আমাদের। অন্যদের ভেতরে কষ্ট থাকলেও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। নিত্যসঙ্গী কষ্টকে যেন নতুন করে তুলে ধরার কিছু নেই।  

এই বাড়ির পেছনে একটু নিচে মাচাংয়ে বসে সুতা কাটছেন খুমাচিং মুরং। সংসারে তার ছেলে-মেয়ে-বউ, নাতি-পুতি রয়েছে। স্বামী নেই। বয়স ৬৮। দেখলে বোঝা মুশকিল।

মেয়েটা পড়েছে নবম শ্রেণি পর্যন্ত। ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে জানা গেলো- এই বয়সেও সুতা কাটা ও তাঁত চালাতে পারেন তিনি। এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন সারা বছর।

দংকই মারমার বয়স ৬৬। থাকেন এ পাড়াতেই। মধ্যদুপুরে তাকে দেখা গেলো বাঁশের তৈরি থুরংয়ে করে বাজার নিয়ে আসতে। কানে ঐতিহ্যবাহী রুপার দুল। এ দুল পরতে পছন্দ করেন তারা। এ  বয়সেও জুমচাষসহ সব কাজই করেন তিনি। ছবি তুলতে চাওয়ায় প্রাণখুলে হেসে রাজি হলেন।

থানচির অন্যতম আকর্ষণীয় অ্যাডভেঞ্চার হলো-নাফাখূম জলপ্রপাতে যাওয়া।

পাহাড়ি বন্ধুর পথে ঘণ্টা চারেক হেঁটে অপার সৌন্দর্যের নির্যাস নিতে নিতে নাফাখূম পৌঁছুনোর পর সব ক্লান্তি যেন কোথায় উবে গেলো।

সেখানে একঘণ্টা সময় কাটিয়ে গেলাম পাশের তকরা পাড়ার তকরা কারবারির বাড়ি।

খেলাম কাচা আম ও ঠাণ্ডা পানি। এখন অবসর তার। জুমে এখনো আগুন দেননি। ঘর ভর্তি তুলা দেখা গেলো, বাঁশের তৈরি ঘরের দুই ফিট বাই দেড় ফিট জানালা দিয়ে চেয়ে।

যে কারবারির বাড়িতে আমরা দুই রাত কাটিয়েছি সেই আদা ম্রো দিনরাত কাজ করেন। তার বয়সও সত্তরের উপর। দু’স্ত্রী। ছেলে-মেয়ে সব বিয়ে দিয়েছেন।

তবে থাকেন যৌথপরিবারে। এক স্ত্রীকে দেখা গেলো জুমের বীজ তৈরি করতে। তার বয়সও নেহায়েত কম নয়।

এক রাতে নিজেই পাহাড়ি আলু লবণ দিয়ে সিদ্ধ করে এনে অকৃত্রিমভাবে আপ্যায়ণ করলেন আমাদের। পাঠিয়ে দিলেন সাঙ্গু থেকে ধরা কালবাউস মাছ।

শুধু লবণ, হলুদ, মরিচ আর সামান্য তেল দিয়ে রান্না সেই মাছের স্বাদ যেন মুখে লেগে রইলো। আর এক রাতে দেখলাম- বাঁশের চাঁচাড়ি জ্বালিয়ে আদা ম্রো একাই কাজ করছেন অনেক রাত পর্যন্ত। কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা ছবি নিলাম তার সঙ্গে।

সমতল ভূমির মানুষের সঙ্গে পাহাড়ি আর আদিবাসীদের জীবন বৈচিত্রের পার্থক্য দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই।

আমাদের বাঙালি পারিবারে যে বয়সে নাতি-পুতি নিয়ে অবসর কাটাতে দেখা যায় পাহাড়ি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সে বয়সেও নিরন্তর পরিশ্রম করে যান জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে।

যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।

থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।

বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন।   খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন

আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড।

এমন একজন গাইড হলেন- মং মারমা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৭-৪১১০১৩ নম্বরে। ফোন করে যদি বন্ধ পান তাহলে বুঝবেন থানচিতে নেই তিনি। হয়তো কারো গাইড হয়ে গেছেন তিন্দু, রেমাক্রি বা বিজয় কেওক্রাডংয়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে তাকে বুক করতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৩
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।