ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

আলোকিত গ্রাম গড়ছে ওরা ১৩ জন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৫৯, জুন ১, ২০১৩
আলোকিত গ্রাম গড়ছে ওরা ১৩ জন

নীলফামারী: কিশোরীগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পুর্ব দলিরাম গ্রাম। দেখতে আর দশটা সাধারণ গ্রামের মতোই।

তবে এই গ্রামের বিশেষত্ব অনেক। এই গ্রামের স্কুলে যাওয়ার উপযোগী প্রতিটি শিশুই স্কুলে যায়, প্রতিটি বাড়িতে স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহার করা হয়, শিশুরা যেকোনো কাজের আগে পরে ভালোভাবে হাত ধুঁয়ে নেয়। অসহায়-অসমর্থকে সহায়তা করা হয়।

তবে এসব অভ্যাস একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে গ্রামের ১৩ জন তরুণের মেধা ও শ্রমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
 
প্রতিটি উপযোগী শিশুতে স্কুলগামী করা, স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, শিশুদের ভালোভাবে হাত ধোঁয়া শেখানোর পাশাপাশি অসহায় দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানো এবং বাল্য বিবাহ রোধে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ওই ১৩ তরুণ তুর্কি।

সরেজমিনে গিয়ে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের সাত নং ওয়ার্ডের পুর্ব দলিরাম গ্রামের মিশুক, রিগান, ইমাম, মিশন, রিমন, রিয়ন, আল আমিন, মামিম, জাকির, লায়ন, মিলু, সাইফুল ও রাকিব মিলে ২০১০ সালে স্থাপন করেন ‘শ্রম কল্যাণ পাবলিক পাঠাগার’।

সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় পাঠাগারের সদস্যরা উপস্থিত থেকে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে নিজেরা আলাপ আলোচনা করেন। সবার সম্মতিতে গৃহীত হয় কর্মপরিকল্পনা। তারা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, স্কুলে যাতায়াত বিষয়ে খোঁজখবর নেন। এছাড়া হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া নিশ্চিত করতে বিনামুল্যে কোচিং প্রদান, শিক্ষা খরচ বহন করা হয়ে থাকে পাঠাগারের পক্ষ থেকে।

আলাপকালে পাঠাগারটির সভাপতি ও বর্তমানে নওঁগা পলিটেকনিক ইন্সিটিউটের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র তৌফিকুল ইসলাম মিশুক বাংলানিউজকে জানালেন তাদের এ আলোকিত যাত্রার শুরুর কথা।

তিনি জানান, তারা সবসময়ই কিছু একটা করার চিন্তা করতেন। এক পর্যায়ে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। তাদের সাহায্য করতে সবার আগে এগিয়ে আসেন গ্রামের বড় বোন মুক্তা আপা। তিনি পাঠাগারে বই রাখার জন্য একটি র‌্যাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ১৩ জন শ্রমিক সেজে গ্রামে বিভিন্ন জনের জমির ধান কেটে ১৩ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন। পরে সাইকেল যোগে রংপুর শহর থেকে ওই টাকার বই কিনে পাঠাগারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন। পাঠাগারের উদ্বোধন করেন তাদের শিক্ষক ফজলুল হক।

পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক ও নীলফামারী সরকারি কলেজের অনার্স পড়ুয়া ইমাম হোসেন জানান, শুরুটা ১৩ জন দিয়ে হলেও পাঠাগারের বর্তমান সদস্য ৭০জনের মতো। সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক ১০টাকা হারে চাঁদা নিয়ে সঞ্চিত টাকায় পাঠাগার উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের শিক্ষাব্যয়, দুঃস্থদের সাহায্য, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা উপকরণ বিতরণ ছাড়াও ঈদ উৎসবে হত দরিদ্র পরিবারগুলোর মাঝে সেমাই চিনি দেওয়া হয়। এছাড়াও লেখাপড়ায় উৎসাহ বাড়াতে গ্রামের কৃতি শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় সংবর্ধনা। এবার ২০ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ভাল ফলাফল করায় তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।

পাঠাগারের সদস্যরা জানান, প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত পাঠাগার খোলা থাকে। তবে নিজস্ব জায়গা না থাকা, পাঠাগারে বসার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত বই না থাকা সর্বোপরি আর্থিক সংকটের কারণে পাঠাগারটি দাঁড়াতে পারছে না পূর্ণাঙ্গভাবে।

গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের সাত নং ওয়ার্ড সদস্য আনিসুর রহমান জানান, পাঠাগারের কার্যক্রম চালানোর জন্য তিনি একটি পাঁকা ঘর দিয়েছেন।  

গ্রামের শরীফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী পাঠাগারটির প্রশংসা করে জানান, এই তরুণরা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

পাঠাগার সদস্য কলেজ ছাত্র মারিফুল ইসলাম ও মিলা আক্তার জানান, শুধু শিক্ষাই নয় শিশুদের ভালভাবে হাত ধোঁয়া, অসুস্থদের সাহায্য, বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় মলত্যাগ না করা এসব নানা বিষয় শেখানো হয়েছে। এছাড়া পাঠাগারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে স্যানেটারি ল্যাট্রিন দেওয়া হয়েছে।

পাঠাগার সূত্র জানায়, সরকারিভাবে চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি গণগ্রন্থাগার থেকে পাঠারগারটি নিবন্ধিত হয়। বর্তমানে এতে বসার ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব, স্থান সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে।

পাঠাগার সদস্যদের প্রশিক্ষণ, যুব ফোরাম গঠন এবং এলাকায় বাল্য বিবাহ রোধে সহায়তা ও পরামর্শ দিচ্ছে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএস।

স্থানীয়ভাবে শিক্ষা প্রসার, রাস্তা ঘাট পরিস্কার পরিচ্ছনতা রাখাসহ আর্তমানবতার সেবায় আলোর পথ দেখাচ্ছে শ্রম কল্যাণ পাবলিক পাঠাগার। সংশ্লিষ্ট ও শুভাকাঙ্খী সবার প্রত্যাশা ১৩ অদম্য তরুণের এই মহৎ উদ্যোগকে আরো এগিয়ে নিতে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৩
সম্পাদনা: সোহেলুর রহমান, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।