ঢাকা: ‘গোসাঁইরহাট’ দেখার জন্য মন উতলা। ঠিক করলাম, ঢাকা থেকে মাওয়া গিয়ে লঞ্চে পদ্মা নদী দেখে মাঝিঘাটে নামব।
বাসে উঠে এক ঘণ্টা পরে পৌঁছালাম শরীয়তপুরে। মিনিট দশেক পরে বাস ছাড়ল। চলছি এবার গোসাঁইরহাটের দিকে। ভাবছি, ওখানে গেলে দেখা হবে গোসাঁইদের সঙ্গে।
কত না গোসাঁই আছে আর এ জন্যই বুঝি নাম হয়েছে ‘গোসাইরহাট’। সজীব একটু হেসে বলে গোসাঁইদের দেশে গিয়ে তাদের কাছ থেকে সে দীক্ষা নেবে। জানব ধর্মের না জানা কথাবার্তা।
পাশের ভদ্রলোক বললেন ‘আরে কি সব বলছেন, নাম গোসাঁইরহাট হলে কী হবে, এখন আর সেখানে গোসাঁই নেই। ধর্মের কথা শুনবেন কিংবা গুরু বলবেন কাকে- এমন লোকের যে বড়ই অভাব এখন। ’
বাস চলছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে, দুই পাশে সবুজ গাছপালা। আহ কী রূপ এই গোসাঁইরহাটে যাওয়ার পথঘাটে। কাছেই ধানক্ষেত বাতাসে দুলছে...।
তখনি সজীব আমার হাতটা ধরে বলল : ‘এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি সকল দেশের রানি সে যে-আমার জন্মভূমি...। দেখুন ওই যে আকাশেও লেগেছে শরতের রূপ...।
বলুন, কোথায় এমন গেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে! সজীব আবার গেয়ে ওঠে তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখির ডাকে জাগে। ’ কথাগুলো শুনে মনে হলো এখানের প্রকৃতির রূপও যেন এমনটি। বাসের হেলপার ভাড়া চাইতেই সজীবের জিজ্ঞাসা, এখান থেকে নদী কত দূর? বেশি দূরে নয়।
পদ্মা-মেঘনা নদী বয়ে গেছে- ওপারে অর্থাৎ পূর্ব পাড়ে চাঁদপুর জেলা। আর এই পাড়ে ভেদরগঞ্জ আর গোসাঁইরহাট...। কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। পাশের ভদ্রলোক বললেন আপনারা বুঝি ভ্রমণে এসেছেন? বললাম হ্যাঁ।
উনি বললেন, গোসাঁইরহাট গিয়ে নাগেরপাড়া, ইদিলপুর, লালমুড়ি, কোদালপুর, গরিবেরচর, সামান্তপুর, ধানকাঠি, দারুল আমান এসব জায়গাতেও যাবেন। এর যেদিকে যাবেন মনে হবে আপনি যেন এসেছেন সোনার দেশে।
এখানের সর্বত্র রূপালী রঙ নদীর জোয়ার প্রাণের সাড়া আনে। তার ঢেউয়ের তালে তালে জীবন জাগে গানে গানে। এই ভালোবাসার আলো ভেদরগঞ্জ বলেন, আর গোসাঁইরহাট বলেন- এর সর্বত্র যেন ছড়িয়ে রয়েছে। কথাগুলো শুনে বারবার মুগ্ধ হচ্ছিলাম। গোসাঁইরহাট যাওয়ার পথে দেখলাম মনোহরবাজার, বুড়িরহাট, ইসলামপুর, ডিনখাম্বা।
বুড়িরহাট সম্পর্কে জানলাম, এক সময় এই এলাকায় হিন্দুদের বসতি বেশি ছিল। ওখানের মসজিদটিও বেশ পুরনো। দেড় ঘণ্টা পরে এলাম গোসাঁইরহাটে। তাকিয়ে দেখি সবই সাধারণ মানুষ। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বেশ বড় বাজার।
ভেবেছিলাম গোসাঁইদের দেখবো, তাদের আখড়ায় যাবো। কিন্তু এর কিছুই চোখে পড়ল না। ওখানের ডাকবাংলোয় উঠলাম। বিকালে বের হলাম। অজানা-অচেনা জায়গায় এসে কত না কিছু দেখার জন্য বারবার উতলা হয়ে উঠলাম।
দেখি, সর্বত্রই ধানক্ষেত, গাছপালা। রাস্তার ধারে পরিচয় হলো এক যুবকের সঙ্গে, সে এখানেরই বাসিন্দা। জানাল, তিন মাস বাড়িতে বসে বসে খায়। বাকি ৯ মাস থাকে দক্ষিণে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ, মুলাদিতে ওখানে হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করে গাঁয়ের এ বাড়িতে-ওবাড়িতে ঘুরে ফেরে।
তার মুখে আরও শুনলাম, পদ্মা-মেঘনা নদী এখান থেকে বেশি দূরে নয় কাছে পিঠে এই দুই বিশাল নদী। পড়ন্ত বিকালে এলাম নদীর তীরে। মাঝি বলল, এখানে পদ্মা শেষ হয়ে শুরু হয়েছে মেঘনা নদী।
বললাম, নদীতে ভেসে বেড়াব বলে এসেছি...। মাঝি একটু হেসে-উঠুন-উঠুন। ওই যে দেখছেন চর ওখানে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি চোখে পড়বে। বিশাল নদী পাড়ি দিয়ে মাঝি বৈঠা বেয়ে এগিয়ে চলছে।
কিছুদূর গিয়েই গাইতে শুরু করল : ‘মন চলে যায় চাঁদের দেশে/মনের রেশে মন হারাবার ছন্দ দোলে গানের রেশে/তরীখানি টলমল কি অপরূপ চঞ্চল...অজানা স্রোতের টানে মোরা চলি ভেসে গো মন চলে যায়...।
মাঝির কণ্ঠে এ গান শুনে জিজ্ঞেস করলাম, পুরনো এ গান কার কাছে শিখেছ? ও বলল, বাবা এক সময় এই গান গেয়ে নৌকা চালাতেন। শুনেছি, তিনি এ গান শিখেছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। কথাগুলো শুনে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার নাম? সত্যরঞ্জন। তবে সবাই ‘সত্য’ বলে ডাকে। আপনিও এ নামে ডাকতে পারেন।
চরে এসে নৌকো ভিড়াল। পানি কাদা দেখে নামতে সাহস পেলাম না। সজীব নেমে এগিয়ে চলল। ফিরে এসে বলল, হাত দিন পানি কাদায় কিছু হবে না। পা দু’খানিতে মাটির স্পর্শ লাগান। বড্ড ভালো লাগবে।
মরলে তো মাটিতেই মিশে যাবেন, তা এতো ভয় কেন? এতগুলো কথা শুনে নিজেকে বড্ড লজ্জিত মনে হলো। চরে নেমে কিছুদূর যেতেই দেখি অনেক গাছ-গাছালির পাশে শেফালী ফুলগাছ। নিচে পড়ে আছে কত ফুল...। সজীব আর আমি দাঁড়িয়ে দেখছি একূল-ওকূল। দেখি এদিকে নদী ওদিকে নদী।
এদিকে সজীব প্রকৃতির মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গান ধরল : কোন প্রভাতের মনে রঙে পথের ধূলি আঁকা সেথায় নাকি ওঠে আধখানি চাঁদ ফাঁকা/তাহার পরে আলোর মুকুট দেখে সোনার লেখা/সেথায় নাকি মন হারালে পায় না মনের দেখা...। সত্যিই এখানে এসে আমরা প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যেন মায়ায় জড়িয়ে ফিরে আসতে কী আর মন চায়! তবুও এলাম। গোসাঁইরহাটের পাড়ে এসে দেখি সন্ধ্যা নেমেছে।
এবার এলাম কালীবাড়ি মন্দিরে। সেখানে ঢুকেই দেখি কীর্তন চলছে। ‘তারও দেওয়া অঞ্জলি যে ঠাঁই নিয়েছে মায়ের রাঙ্গা পায় তোরা দেখরে নয়ন ভরে’ কীর্তনে এ রকম কথাগুলো শুনে কী আর ফিরে আসা যায়। দেখি ঢোল বাজে- বাদ্য বাজে কীর্তনীয়ারা নেচে নেচে গেয়ে চলছে।
পরদিন এলাম ইদিলপুরে। সেই ক্ষণে স্মৃতিতে ভেসে উঠল পুরনো দিনের কথা। ১৯৭৩ সাল, ঢাকা থেকে লঞ্চে ফিরছিলাম হুলারহাটে। পাশে ছিলেন শৈলেন্দ্রনাথ রায় নামের এক ভদ্রলোক। তিনি নেমে যাবেন পট্টি- সেখান থেকে গোসাঁইরহাট।
বয়স প্রায় ৫০ বছর। অনেক কথা হলো তার সঙ্গে। তিনিই জানিয়েছিলেন, ‘গোসাইরহাটের ইদিলপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী গীতা রায়। জন্মের কয়েক বছর পরই উনি চলে গেলেন মুম্বাইয়ে (বোম্বে)।
ওখানে থাকতেন ওর বড় ভাই মুকুল রায়। কী-না সুমিষ্ট গলা, কেন তুমি কী শোনোনি ‘হারানো সুর’ ছবির ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’ গানটি। ’ মাথা নেড়ে বললাম হ্যাঁ ‘হারানো সুর’ ছবিটাও দেখেছি।
শৈলেন্দ্রনাথ রায় আরও জানালেন, ‘গুরু দত্তকে বিয়ে করার পরে গীতা রায় হলো ‘গীতা দত্ত’। উনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট।
কিন্তু দুর্ভাগ্য মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে তিনি মারা যান। ’ শৈলেন্দ্রনাথ রায়ের বলা সেদিনের একথাগুলো ভাবতে ভাবতে এলাম ইদিলপুরে। ছায়া ঢাকা মায়ামাখা গাঁওখানি দেখে ভাবলাম, গীতা দত্তের জন্মস্থান ইদিলপুর একথা ক’জনইবা জানে!
গোসাঁইরহাট সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য : গোসাঁইরহাট যেতে হলে ঢাকা থেকে বাসে উঠে মাওয়া, মাওয়া থেকে লঞ্চে উঠে মাঝিঘাট নামতে হবে। ওখান থেকে বাসে পালং নেমে আবার বাসে উঠে গোসাঁইরহাটে যাওয়া যাবে। সময় লাগবে প্রায় ৬ ঘণ্টা।
গোসাঁইরহাটে উপজেলা অফিস আছে, এখানের বড় ইউনিয়ন ইদিলপুর। নদীপথে পট্টি নদীবন্দরে নেমে রিকশা নিয়ে গোসাঁইরহাট আসা যায়। গোসাঁইরহাটের কাছে পিঠে খাসিরহাট এখান থেকে ট্রলারে বরিশালে হিজলা ও মুলাদি যাওয়া যাবে।
গোসাঁইরহাট থেকে ডামুড্যার দূরত্ব ৭ কি.মি.। ডামুড্যার পাশে পদ্মার শাখানদী এখানে রয়েছে পুরনো বাজার গোসাঁইরহাট থেকে ভেদরগঞ্জের দূরত্ব ১০ কি.মি.। এখানের আলুবাজার থেকে লঞ্চ ও ট্রলারে করে মেঘনা পাড়ি দিয়ে ওপারে চাঁদপুরে যায়। ভেদরগঞ্জ থেকে আলুবাজারের দূরত্ব ১০ কি.মি.।
খরচ পড়বে : তিন দিন সময় হাতে নিয়ে গেলে গোসাঁইরহাট, ইদিলপুর, ডামুড্যা, লালমুড়ি, গরিবেরচর, ভেদরগঞ্জ দেখা হয়ে যাবে। একই সঙ্গে পদ্মা-মেঘনার চরেও বেড়ানোর সুযোগ হবে।
এ ভ্রমণে একত্রে দু’জন গেলে ভালো হয়। জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে নিয়ে গেলেই চলবে।
বাংলাদেশ সময় : ২০৪৪ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০১৩
খোকন/সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর