ঢাকা: শুধু স্বাদ আর ঘ্রাণ নয়, আকর্ষণীয় রঙ যেকোনো খাদ্যের আবেদন নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাবারের এই যুগে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য কোম্পানিগুলো বাহারি স্বাদের পাশাপাশি বাহারি রঙও ব্যবহার করে থাকে।
তবে ভোক্তারা বরাবরই এসব খাবারের রঙ নিয়ে বেশ বিচলিত থাকেন। অনেক দেশেই কৃত্রিম রঙ মেশানো যেকোনো খাবার বর্জনের জন্য আন্দোলন-প্রতিবাদ হয়েছে, হচ্ছে। যাতে সচেতন হয়ে অনেক ভোক্তা কৃত্রিম রঙের আলামত পেলেই সেসব খাবার বর্জন করছেন।

কিন্তু শুভঙ্করের ফাঁকিটা এখানেই!
‘প্রাকৃতিক রঙ’ ভেবে নিশ্চিন্ত মনে যেসব ক্রেতা বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবার কিনছেন, তাদের জানার উপায় নেই এই প্রাকৃতিক রঙ কীভাবে আসছে।
উদাহরণ হিসেবে বিশ্বের বৃহত্তম কফি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান স্টারবাকসের কথা বলা যায়। সম্প্রতি কোম্পানিটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে তাদের ফুড কালারিং পদ্ধতি নিয়ে। যদিও এতে ক্ষতিকর তেমন কোনো উপাদান নেই, তারপরও স্টারবাকসের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় ফ্রাপাচিনোর আকর্ষণীয় রঙের পেছনের চিত্রটি জানলে অনেকেরই আর এই সুস্বাদু পানীয়টি গ্রহণ করার রুচি হবে না।
কফি, স্ট্রবেরি, বরফ কুচি ও ক্রিম মেশানো ফ্রাপাচিনোর আকর্ষণীয় রঙের রহস্য সচিত্র তুলে ধরা হলো--
১. মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের ক্যাকটাসে বাস করে কচনিল নামে গুবরে পোকার মতো এক ধরনের প্রাণী।
২. এসব পোকা ক্যাকটাস ও লাল রঙের ফল খেয়ে থাকে। এ রঙ কচনিলের দেহে দ্রবীভূত হয়ে যায়। তাই একটি কচনিল পোকাকে চাপ দিলে ছবির মতো লালচে রঙ পাওয়া যায়।

৩. বাণিজ্যিকভাবে এই রঙ উৎপাদনের জন্য দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়- প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম। তবে দুই পদ্ধতিতেই পোকাগুলোর সর্বোচ্চ বংশবৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। চাষের প্রতিটি চক্রের ব্যাপ্তি তিন মাস।
৪. কৃত্রিম পদ্ধতিতে পোকাগুলোর জন্য জ্যাপোটেক নেস্ট নামে এরকম ছোট ছোট ঝুড়ি তৈরি করা হয়। এতে স্ত্রী পোকাগুলো সংরক্ষিত থাকে।
৫. প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কৃষকেরা কচনিল আক্রান্ত ক্যাকটাসের চাষ করে ও পোকাগুলোকে বংশবৃদ্ধির সুযোগ দেয়।
৬. তিন মাস পার হলে সব কচনিল সংগ্রহ করে একটি কাঠের পাত্রে ঢালা হয়।
৭. পাঁচ-ছয় মিনিট ধরে বিশেষভাবে পাত্রটিকে নাড়ানো হয়, যার ফলে পোকাগুলো মারা যায়, তবে তাদের দেহের রঙের কোনো পরিবর্তন হয় না। এছাড়া গরম পানি বা ওভেন দিয়ে তাপ দিয়েও এ কাজটি করা হয়।
৮. সব পোকা মারা যাওয়ার পর শুকানোর জন্য দুই-তিনদিন তাদের সূর্যের আলোয় রেখে দেওয়া হয়। এরপর দেহের উচ্ছিষ্টাংশ ঝেড়ে ফেলার জন্য একটি বড় ছাঁকনিতে রেখে ছাঁকা হয়।

৯. শুকিয়ে যাওয়া পোকাগুলোকে এরপর সহজেই লাল রঞ্জক পদার্থে পরিণত করা যায়। এর জন্য প্রথমে সেগুলোকে গুঁড়া গুঁড়া করা হয়।
১০. সেই গুঁড়া পাউডারে একটু পানি মিশিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলেই তৈরি হয়ে যায় চূড়ান্ত কোচনিল রঞ্জক।
১১. এ রঞ্জককে অনেক খাদ্যে সরাসরি রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো খাদ্যে একে আরও প্রক্রিয়াজাত করে ক্যারমিন নামে ব্যবহার করা হয়।
প্রসঙ্গত, যে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হোক না কেন, মাত্র এক পাউন্ড কচনিল রঞ্জক পেতে প্রায় ৭০ হাজার পোকার দরকার হয়। পেরু প্রতিবছর ২০০ টন কচনিল রঞ্জক উৎপাদন করে। কৃত্রিম রঙের ব্যবহার চালু হওয়ার পর মাঝে কচনিল চাষ অলাভজনক হয়ে পড়লেও বর্তমানে বৃহৎ খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক চাহিদায় নতুন করে বিভিন্ন দেশে এর চাষ শুরু হয়েছে।

শুধু স্টারবাকস ও কচনিল নয়। পোকামাকড় গুঁড়া করে খাবারের রঞ্জক তৈরির এ পদ্ধতিটি বেশ পুরনো, এবং অসংখ্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। লাল, গোলাপী বা লালচে রঙের যেসব বিদেশি প্রক্রিয়াজাত খাবার প্রতিদিন কিনছেন, তার প্যাকেটের গায়ে লেখা ‘ইনগ্রেডিয়েন্টস’ বা উপাদানগুলো দেখুন। ক্যারমিনিক এসিড, ক্যারমিন বা কচনিল এক্সট্রাক্ট লেখা থাকলে বুঝবেন উপরের পদ্ধতিতেই এ খাবার রঙ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ন্যাচারাল রেড ফোর, ক্রিমসন লেক, ই১২০ কথাগুলোও ব্যবহার করা হয়।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, যেসব খাদ্যে এ ধরনের রঞ্জক ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে রয়েছে- হিমায়িত মাংস ও মাছ, সফট ড্রিঙ্কস, ফ্রুট ড্রিঙ্কস, পাউডার ড্রিঙ্কস, দই, আইসক্রিম, দুগ্ধজাত রঙিন খাদ্য, চকলেট, সিরাপ, চুইংগাম, জেলি, জ্যাম ও সস প্রভৃতি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৪ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৩
আরআর