রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।
বান্দরবান থেকে ফিরে: জীবন-জীবিকার আর সব ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা-দীক্ষায়ও সমতলের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে পাহাড়িরা। এক্ষেত্রে চাকমা আর মারমারা কিছুটা এগিয়ে গেলেও অধিকাংশ জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
বান্দরবানের দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকা থানচি উপজেলার তিন্দু, রেমাক্রি, আদাপাড়া, ছোটমোদক প্রভৃতি স্থানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে- পর্যাপ্ত স্কুল, মানসম্মত শিক্ষক, আবাসন সুবিধার অভাবে এখনো আলো বঞ্চিত অধিকাংশ পাহাড়ি শিশু।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব প্রকট। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিউম্যানেটেরিয়ান কারিতাস ও ব্র্যাকের কিছু স্কুল শিক্ষাসেবা দিচ্ছে অঞ্চলগুলোতে। রয়েছে কিছু মিশনারিজ স্কুল, যেগুলোতে জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষাদান চলছে কোনোরকমে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিউম্যানেটেরিয়ান ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’র থানচি উপজেলার সমন্বয়ক সুমন ত্রিপুরার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, থানচি উপজেলায় মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৪টি, আর বেসরকারি বা এনজিও পরিচালিত স্কুল ১৫০টি। এসব স্কুলে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। এছাড়া হাইস্কুল আছে ১টি। নাম থানচি উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে মোট চারশ’ শিক্ষার্থী তাদের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে রেমাক্রি ইউনিয়নের আদাপড়া গ্রামে বেসরকারি একটি স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, দু’জন শিক্ষক ২৩-৩০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন। সময় তখন বিকেল ৪টা। সাধারণ স্কুল বসে সকালে। তবে এক গ্রামের শিক্ষার্থী হওয়ায় ঘণ্টা বাজিয়ে ডেকে বিকেলেও মাঝে মাঝে ক্লাস নেন শিক্ষকরা। স্কুলের অবকাঠামো বলতে দু’টি রুম, ব্লাকবোর্ড, কয়েকটি শিক্ষামূলক ছবি।
স্কুল শিক্ষক অমাচিং মারমা বলেন, “ওদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রথম প্রথম কষ্ট হয়। যা বোঝে না তা আমরা মারমা কিংবা ত্রিপুরা ভাষায় বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করি। বিশেষ করে মারমা ভাষায়। কারণ এ ভাষাটাই এখানে মোটামুটি সবাই বোঝে। তাছাড়া এখন সব ভাষার বর্ণমালাও তো নেই। ”
হিউম্যানেটেরিয়ানের পরিচালক মং মং সিং-এর কাছে প্রিস্কুলিংয়ের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ আমরা যদিও একটি বেসরকারি সংস্থা, তবু আমরা আসলে সরকারি কারিকুলামই ফলো করি। সে হিসেবে শিশু শ্রেণিতে যারা পড়ে তাদের শতভাগ মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। এভাবে পর্যাক্রমে প্রথম শ্রেণিতে ৮০ ভাগ, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৬০- এভাবে পঞ্চম শ্রেণিতে এসে তাদের আবার শতভাগ বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়। ”
মিশনারিজ চালিত ছোটমোদক প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা টিনের তৈরি ঘরে কোনোরকমে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। রোদের তাতে সিদ্ধ হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী। মাটির মেঝে থেকে ধুলা উড়ছে।
স্কুলটির শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৫ জন। শিক্ষার্থীরা দু’টি ক্লাসে বিভক্ত হয়ে ক্লাস করছে। শিক্ষক একজন। আবার একই ক্লাসে বসেছে থ্রি থেকে ফাইভ পর্যন্ত শিক্ষার্থী।
কথা হয় শিক্ষক ওলসান ত্রিপুরার সঙ্গে। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। বাবা মারা যাওয়ায় অর্থের অভাবে আর পড়া হয়নি। নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি মাত্র ১২শ’ টাকা বেতনে পড়াচ্ছেন এ স্কুলে।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “আমি চাই, আমি যেটা অর্থের অভাবে পারিনি এই বাচ্চারা যেন সেটা পারে। ”
পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়ানো সম্পর্কে কিছুটা যেন আশার বাণী শোনান চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসরিন সুলতানা।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি শিক্ষাসচিব বরাবর স্কুলের জন্য আবেদন করে, স্কুল পাবে। এ মুহূর্তে একটি প্রকল্পও চলছে। ইচ্ছে করলে তারা আগে আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারে। ”
পাহাড়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে থানচি উপজেলা শিক্ষা অফিসার ফিরোজ আহমেদ বলেন, “গোটা বান্দরবান জেলায় বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অনুমোদন পেয়েছে। বাকিগুলো অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ”
তিনি আরও জানান, এমপিও ভুক্ত স্কুলগুলো এবং পরবর্তীতে ইউএনডিপি’র ৮৩টি স্কুল সরকারিকরণ করা হবে। এছাড়া ঝরে পড়া ছাত্রদের জন্য বা যারা দেরিতে স্কুলে যায় তাদের জন্য ‘আনন্দ স্কুল’ নামে একটা প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে।
ড. কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশন অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যে সব এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই সেসব এলাকায় এ ব্যবস্থা নেওয়ার উপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান ফিরোজ আহমেদ।
এছাড়া বাচ্চারা যাতে স্কুলের প্রতি আগ্রহী হয় সেজন্য স্কুল ফিডিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিউম্যানেটেরিয়ানও এর সঙ্গে জড়িত।
যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।
থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।
বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন। খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড। এমন একজন গাইড হলেন- মং মারমা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৭-৪১১০১৩ নম্বরে। ফোন করে যদি বন্ধ পান তাহলে বুঝবেন থানচিতে নেই তিনি। হয়তো কারো গাইড হয়ে গেছেন তিন্দু, রেমাক্রি বা বিজয় কেওক্রাডংয়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে তাকে বুক করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৯ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৩
জেডএম/