ঢাকা: উপমহাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের দাদার ভাই (পিতামহ) সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী। ১৮৭০ সালের দিকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর মশুয়া গ্রামেই খেলা শুরু করলেন তিনি।
কিন্তু সেই অগ্রদূত সারদারঞ্জন চৌধুরীর এই ভারতবর্ষ প্রায় দেড়শ বছর পরে এসে বাজিকরের খনিতে পরিণত হয়েছে। এই অঞ্চলে ক্রিকেটে এখন বাজিকর, ম্যাচ ফিক্সিং ও স্পট ফিক্সিং আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কালো থাবা এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটেও।
বিশ্বের কোটি কোটি ক্রীড়ামোদি দর্শকদের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটকে কলুষিত করার জন্য এক ধরনের লীলায় মেতে উঠে একদল অসাধু ব্যাক্তি। যারা বিভিন্ন খেলার আগেরদিন খেলার বিভিন্ন গতিপথের ওপর বাজি ধরেন। আর এ বাজিতে জেতার জন্য অনেক সময় তারা খেলোয়াড়দের গোপনে অর্থ দিয়ে থাকেন। তাদের ফাঁদে পড়ে নিন্দিত এবং নিষিদ্ধ হয়েছেন ক্রনিয়ে, আজহার উদ্দিন, বাট ও আমেরের মতো তারকা ক্রিকেটাররা। এ অসাধুরা আমাদের কাছে বাজিকর ও জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত।
শুধু পেশাদার বাজিকরই নয়,বিভিন্ন সময়ে ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে আম্পায়ার, বলিউডের অভিনেতা, বিভিন্ন ফাঞ্চাইজির মালিক ও শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
আর এ রকম এক বাজিকরের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়াত সাবেক অধিনায়ক ক্রনিয়ের পরিচয় করিয়ে দেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক আজহার উদ্দিন। ওই বাজিকরের নাম মুকেশ গুপ্ত। বেশির ভাগ সময়ে বাজিকররা যোগোযোগ রাখতো যে বেশির ভাগ দলের অধিনায়কের সঙ্গে।
আমাদের সবারই মনে আছে ২০১০ সালে ইংল্যান্ডে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের স্পট ফিক্সিংয়ের কথা। যে ঘটনার জের এখনো টানতে হচ্ছে তিন পাকিস্তানি ক্রিকেটার সালমান বাট, মোহাম্মদ আমের ও মোহাম্মদ আসিফের।
ওই ঘটনায় পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বাজিকর মাজহার মাজিদ স্কটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিলো। পরে অবশ্য তিনি জামিনে মুক্তি পান। ইংল্যান্ডের দি সানের সাপ্তাহিক আয়োজন নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের ক্রিকেট জুয়ায় বিশেষ করে স্পট ফিক্সিংয়ের চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। ঐ প্রতিবেদনে অনুযায়ী মাজহার মাজিদই ঐ জুয়ার প্রধান বাজিকর। দেড় লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের তিনি স্পট ফিক্সিংয়ের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।
নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের যে দুই সাংবাদিক বাজিকর সেজে ১০ হাজার পাউন্ড দিয়ে মাজহার মাজিদের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিলেন। পরে সাংবাদিকদের সামনে মাজহার মাজিদ আমির ও আসিফের সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেন। আর স্পট ফিক্সিংয়ের অংশ হিসেবে মোহাম্মেদ আমের,আসিফ লর্ডস টেস্টের তৃতীয় দিনে নির্ধারিত ওভারে নো বল করবেন, সে খবরও আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছিলেম। এসব কথা বার্তা প্রতিবেদনে প্রকাশ হবার পর গ্রেফতার হয়েছিলেন মাজহার মাজিদ। পরে ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় বিভিন্ন মেয়াদের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলো বাট, আমের ও আসিফ।
এদিকে চলতি বছরের আইপিএল-এ স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করে ভারত পেসার শ্রীশান্থ ও অপর দুই ক্রিকেটার অঙ্কিত চ্যাবন ও অজিত চণ্ডীলাকে। অভিযুক্ত ক্রিকেটাররা চলতি আইপিএল-এ রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলছিলেন। অভিযুক্ত তিন ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে স্থানীয় মুম্বাই মেরিন ড্রাইভ থানায় মামলা হয়েছিলো। আর এ ঘটনায় পদ থেকে সরে গেছেন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট এন শ্রীনিবাসনও। গ্রেফতার হয়েছেন তার জামাইও। যদিও তিনি এখন জামিনে মুক্ত।
অভিযোগ রয়েছে, জড়িতরা আইপিএল‘র দুই খেলায় জুয়াড়ি জিজু জানারধন থেকে প্রায় এক কোটি রুপি গ্রহণ করেছেন।
২০১১ সালে বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সন্দেহভাজন ২৫ জুয়াড়িকে শনাক্ত করেছিলো আইসিসি। ম্যাচ ফিক্সিং ঠেকাতে তখন এ সব জুয়াড়ির বাংলাদেশে প্রবেশ ঠেকাতে বিমানবন্দরগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। আইসিরি এ সব সন্দেহভাজন জুয়াড়ির তালিকা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়।
ওইদিন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বাজিকরেরা যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তখনকার সন্দেহভাজন এই ২৫ জুয়াড়ির মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ১১ জুয়াড়ি হলো- অসীম খিতিরপাল, অতনু দত্ত, পাপু ভূটানি, চেতন বালরাম চন্দন, বরম্নণ গান্ধী, অরবিন্দ সিং খোসা, রাজ পাল আরোরা, সুনিল পাশসামালাল ভাটিয়া, রাহুল গুপ্তা, অরুণ ভাট, সমির খান্না।
অসীম খিতিরপাল মুম্বাইয়ের নামকরা বাজিগর জগদীশ সোদার দীর্ঘদিনের সহযোগী। তার বিরুদ্ধে ১৯৯৯-২০০০ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত একটি টেস্ট ম্যাচে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে। এ সময় তিনি একজন খেলোয়াড়কে ম্যাচ গড়াপেটার জন্য তিন লাখ পাউন্ড দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। লন্ডন মেট্রোপুলিশ বিষয়টি জানার পর অসীম খিতিরপাল ইংল্যান্ড থেকে ভারতে চলে এসে রক্ষা পান। খিতিরপালের ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর- জি ৪৭৯১৭০২।
কলকাতার বাসিন্দা অতনু দত্ত ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর-০০৯৬০০৪। তার বিরুদ্ধে ২০১০ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশগ্রহণকারী দলের খেলোয়াড়দের পেছনে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করার অভিযোগ রয়েছে।
ভারতের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আজাহরউদ্দিনকে দিয়ে ম্যাচ পাতানোর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে পাপু ভূটানির বিরুদ্ধে। ভারতীয় হলেও থাকেন হংকং এ। সেখানে বসেই ম্যাচ পাতানোর কলকাঠি নাড়েন তিনি।
ভারতীয় আরেক নাগরিক সন্দেহভাজন চেতন বালরামের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। যিনি বিভিন্ন দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক করে বাজি ধরার কাজটা করে থাকেন। তাঁর ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর- এ ১৮৭১০৮৫।
এরা ছাড়াও ভারতের পাঞ্জাবের বাসিন্দা বরম্নণ গান্ধী (ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর জি-৬৭৪৯৩৭৮), অরবিন্দ সিং খোসা,(পাসর্পোট নম্বর জি ৫৩৯৯৫৪১), ভারতীয় বংশদ্ভোত রাজ পাল আরোরা (ইংল্যান্ডের পাসপোর্ট নাম্বার-৮০১২১৩৭৮০), নাগপুরের সুনিল পাশসামালাল ভাটিয়া, অরুণ ভাট (ভারতীয় পাসপোর্ট নং-এফ-৩১৯৪৯৭৮), অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রাহুল গুপ্তা, হরিয়ানার সমির খান্নার (পাসপোর্ট নম্বর জে-০০৫১৪৪২)বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ম্যাচ গড়াপেটার শক্ত অভিযোগ রয়েছে।
সারদারায়ের এই মাটিতে বসেই তারকা ক্রিকেটার আশরাফুল জড়িত হয়েছেন ফিক্সিংয়ে।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ২০০৪ সালে শততম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ হারিয়েছিল ভারতকে। অভিযোগ রয়েছে, ওই ঐতিহাসিক ম্যাচ থেকে আশরাফুল পাতানো খেলা শুরু করেন আশরাফুল। ক্রিকেটার খালেদ মাহমুদ, খালেদ মাসুদ ও মোহাম্মদ রফিক ম্যাচের আগের দিন হোটেলেই জাভেদ নামে ভারতীয় এক বাজিকরের সঙ্গে আশরাফুলকে পরিচয় করিয়ে দেন।
ওই ম্যাচে ফিক্সিংয়ের জন্য আশরাফুল পান সাড়ে চার লাখ টাকা। এরপর ২০০৯ সালে খালেদ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে ফেরার পর খালেদ মাহমুদ সুনীল ভাটিয়া নামে এক ভারতীয় বাজিকরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আশরাফুলকে। ওই সময় মোহাম্মদ রফিকও উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট, ২০১২ সালের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, শ্রীলংকার প্রিমিয়ার লীগেও ফিক্সিং এর অভিযোগ রয়েছে আশরাফুলের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জুন ১২,২০১৩
এমইএস/সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর