ড্যানি অ্যাশওয়ার্থ। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক।
সময় কাটছে উদ্বেগ উৎকন্ঠায়। ড্যানি বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কি হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে। চোখ খুলেই তিনি কি দেখবেন? এটাও সবার কাছেই অজানা।
ড্যানি ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। প্রথম চোখ খোলা মাত্রই সামনে একটা আলোর ঝলক দেখতে পেলেন। তারপর কিছু সাদা কালো লাইন ও ধোঁয়াশার মতো ছবি চোখের সামনে ভাসতে থাকল। আস্তে আস্তে চারপাশের সব কিছু উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। প্রথমবার জীবনের ছবি দেখে তিনি আনন্দ ধরে রাখতে পারছিলেন না।
প্রসঙ্গত, এ ঘটনা ২০১১ সালের। প্রথমবারেই পরীক্ষা করে সফল হওয়া অস্ট্রেলিয়ার বায়োনিক ভিশনের গবেষক দলেরও আনন্দের অন্ত ছিল না। তারপর পথচলা শুরু। পুরো দমে কাজ। তাদের সঙ্গে যোগ দিল ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি।
তবে এমন গবেষণা একার পক্ষে অসম্ভব। সময়ে সময়ে বহু মানুষকে কাজ করতে হয়েছে এ গবেষণার বিভিন্ন ধাপে। তেমনই দুজন গবেষককে নিয়েই স্বপ্নযাত্রার এবারের প্রতিবেদন।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলসের বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ওয়েনতাই লিউ। প্রায় দুদশক ধরে বায়োনিক চোখ নিয়ে গবেষণা করছেন। বলা হয়, লিউ প্রথম গবেষক যিনি বায়োনিক চোখ নিয়ে প্রথম পর্যায়ের সফলতা পেয়েছেন।
লিউয়ের বায়োনিক চোখের নাম ‘আরগুস টু রেটিনাল প্রোসথিসিস’ সিস্টেম। যাদের বিভিন্ন রোগের কারণে চোখের রেটিনার লাইট সেনসিটিভ রিসিপ্টর ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। লিউ ও তার দল এ ধরনের অন্ধদের জন্যই কাজ শুরু করেন।
এ বায়োনিক চোখের জন্য রোগীর চোখে বসানো হয় মাইক্রো চিপ ও ওয়্যারলেস অ্যান্টেনার সার্কিট। যা চোখের অপটিক্যাল নার্ভকে সিগনাল অনুযায়ী ইলেকট্রিকাল ইমপাল্স পাঠায়। আর বাইরে একটা চশমাতে বসানো ক্যামেরা ও ওয়্যারলেস অ্যান্টেনার সাহায্যে ভিতরে সিগনাল পাঠানো হয়।
বর্তমানে এটি ৬০টি মাইক্রো চিপের সাহায্যে ৬০টি পিক্সেল নিয়ে কাজ করতে পারে। যদিও এটি আসল চোখের রেজ্যুলিউশনের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু যারা অন্ধ তাদের জন্য এটি স্বর্গ পাওয়া। তবে গবেষক দল ২৫৬ এবং ১০২৬ পিক্সেল নিয়ে এরই মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তারা ৭০ বছর বয়সের একজন অন্ধ মানুষের ওপর এটি পরীক্ষা করেছেন যিনি ২০ বছর বয়সে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন।
ওয়েনতাই লিও তার বায়োনিক চোখ নিয়ে বেশ আশাবাদি। তিনি বলেন, একদিন প্রতিটি মানুষ এ সুন্দর পৃথিবী দেখতে পাবে। এ পৃথিবী যে কত সুন্দর তা দেখে তাদের বিস্ময়ের অন্ত থাকবে না।
লিউ আরও বলেন, আমি এটি নিয়ে যত কাজ করব, তত মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করতে পারব। হিউম্যান ব্রেইন হলো সবচেয়ে ক্ষমতাধর। তাকে একবার বুঝতে পারলেই সব কিছু সম্ভব।
গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাবার স্বপ্ন ছিল আমি যেন ডাক্তার হই। কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। এ জন্যই এ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি বাবাকে প্রমাণ করলাম, শুধু ডাক্তার হয়েই রোগীর সেবা করা সম্ভব না। এ জন্য প্রয়োজন উদ্ভাবক হওয়া। যা আমি হতে পেরেছি।

গ্রেগ মূলত কাজ করেছেন ককলিয়ার নিয়ে। ককলিয়ার হলো কানের বিশেষ অংশ। বাইরে যে শব্দ আমাদের কানে প্রবেশ করে। সেটিকে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয় ককলিয়ার। মস্তিষ্ক তখন সেই অনুযায়ী আমাদের দিকনির্দেশনা দেয়। গ্রেগ ককলিয়ারের এ আইডিয়া নিয়েই কাজ শুরু করেন।
তার প্রধান কাজ হয় শব্দ শুনে মানুষ যেন পড়তে পারে। গ্রেগ এটিকে ককলিয়ারের বর্ধিত কাজ বলেই শুরুতে উল্লেখ করেন।
গ্রেগ ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসেলের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার। তার দলের সবাই ককলিয়ার নিয়ে কাজ করে মূলত রাতকানাদের (রাতে যারা চোখে দেখতে পায় না) জন্যই । প্রথমে তারা একটি চিপ তৈরি করেন।
এটি রেটিনার সঙ্গে লাগানো থাকবে। চোখের ওপর একটি লেন্সও লাগানো হবে। যেখানে ক্যামেরা বাসানো হবে। ওই চিপটি বাইরে থেকে ছবি নেবে। তারপর চোখের লেন্সে সেই ছবি ভাসিয়ে তুলবে।
গ্রেগ বলেন, চিপটি যেহেতু সাধারণ আলো ব্লক করে দেবে। সেহেতু এটি অন্ধদের কাজে দেবে। প্রথম লক্ষ্য হলো অন্ধ মানুষটিকে রাত-দিন বোঝার ক্ষমতা তৈরি করে দেওয়া। ধীরে ধীরে তারা বস্তুর নড়াচড়া দেখতে পাবে। বিশেষ করে পড়তেও পারবে।
বায়োনিক চোখ একজনের প্রচেষ্টায় তৈরি হচ্ছে না। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত চেষ্টায় তৈরি হচ্ছে বায়োনিক চোখ। যদিও এখনও ব্যবসায়ীক পণ্য হিসেবে বাজারে এটি আসেনি।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক আরও আধুনিক বায়োনিক চোখ তৈরি করে বিষয়টি আবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে। এ উদ্ভাবনও দলগত প্রচেষ্টা। এভাবেই একদিন অন্ধদের জন্য আলোর পথ খুলে দেবে বিশ্বের উদ্ভাবনী গবেষকেরা।
অনুবাদ: শেরিফ সায়ার
বাংলাদেশ সময় ১৭৩৩ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর