রাঙামাটি-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেড়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম ছুঁয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর বান্দরবানের পরতে পরতে যেন নিজেকে মেলে রেখেছে প্রকৃতি। দেশের সর্বোচ্চ দুই পাহাড় তাজিনডং ও কেওক্রাডং, সর্বোচ্চ খাল রাউখিয়াং এ জেলার অন্যতম আকর্ষণ।
বান্দরবান থেকে ফিরে: জুমের চক্রে বাঁধা যাযাবর জীবনই শিক্ষার প্রধান অন্তরায় পাহাড়ি জীবনে। নেই পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা। সচেতনতারও অভাব প্রকট। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও গড়ে তোলা সম্ভব হয় না জুমের পাহাড় পাল্টানোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরিয়ে নেওয়া পাহাড়ি বসতিতে। পাহাড়ি পথের দুর্গম যোগাযোগও যেন শিক্ষার আলো থেকে আড়াল করে রাখে পাহাড়িদের।
কিন্তু এসব অন্তরায় কাটিয়ে শিক্ষার আলায় আলোকিত হতে না পারলে জীবন ও জীবিকার ওপরে চেপে থাকা আঁধার যে কাটবে না তা এখন ভালোই বুঝছে পাহাড়ের মানুষ।
বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বশেষ ইউনিয়ন রেমাক্রি’র সাবেক চেয়ারম্যান মং ফু অং এর কথাতেই তাই একই সুর।
বাংলানিউজকে তিনি জানান, যতক্ষণ পাহাড়িরা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে না পারবে, ততক্ষণ তাদের অবস্থার উন্নয়ন হবে না। এ বিষয়ে তাদের রয়েছে নানা দাবি।
চেয়ারম্যান থাকাকালে নিজে উদ্যোগ নিয়ে রেমাক্রিতে একটা হোস্টেল খুলেছিলেন মং ফু অং। সেখানে ছয় বছর একশ’ বাচ্চাকে পড়িয়েছেন কারও কাছ থেকে কোনো অর্থ না নিয়ে। তার কাছে ইউনিয়ন পরিষদের যে ত্রাণ আসত তা দিয়ে দিতেন বাচ্চাদের।
মং ফু অং জানেন, শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই তারাও চান এগিয়ে যেতে।
তিনি বলেন, “কে না চায় এগিয়ে যেতে? আমরাও চাই। আমরা সরকারের কাছে দাবি করি, এমপিদের কাছে দাবি করি। আমাদের প্রয়াত রাজা মংশৈ প্রু পাকিস্তান আমলে মন্ত্রী থাকাকালে প্রতি তিন কিলোমিটারে একটি করে স্কুল করে দিয়েছিলেন। সরকারি প্রাইমারি স্কুল, সঙ্গে শিক্ষক। এরপর ’৭১ এর সংগ্রামের সময় শিক্ষকরা পালিয়ে যায়। এরপর থেকে সব ভেঙে গেছে। তারা অনেকেই চলে যান বান্দরবানে। ”
মং ফু বলেন, “স্কুল না থাকার আরেকটা কারণ হলো আমাদের পাহাড়িদের জীবন জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। আর একটা পাহাড়ে একবার জুম চাষের পর সে পাহাড়ে আর ৪-৫ বছর জুম চাষ করা যায় না। করলেও ফলন ভালো হয় না। এমতাবস্থায় জুম চাষীদের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে বসতি স্থাপন করতে হয়। এতে করে যে পাহাড় তারা ছেড়ে যায় সেখানে স্থাপন করা স্কুল পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কারণ স্কুল তো আর উঠিয়ে নেওয়া যায় না সবসময়!”
শিক্ষিত হয়ে আপনারা এগিয়ে যেতে চান কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা অবশ্যই শিক্ষিত হতে চাই। কিন্তু আমাদের এখানে শুধু স্কুল করে দিলে হবে না। যেমন আমাদের পাড়ার কথাই ধরা যাক। এ পাড়ায় কোনো স্কুল নেই। আছে নদীর ওই পাড়ে। বর্ষাকালে নদী ভরে যায়। তখন ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে হয় আমাদের পাড়ায় স্কুল করে দিতে হবে, নয়ত যেখানে স্কুল আছে এর পাশাপাশি হোস্টেল করে দিতে হবে। ”
মং ফু বলেন, “এছাড়া পাহাড়িদের বাড়িতে লেখাপড়া করার মতো পরিবেশও নেই। আমাদের পাহাড়িদের ঘরগুলো ছোট ছোট। এখনো ৯ হাত করে একটা ঘর। পুরো ফ্যামিলি সেখানে থাকে। মেহমান এলেও সেখানেই থাকতে হয়। তাহলে তারা পড়াশুনা করবে কোথায়?”
শিক্ষার সুযোগ সুবিধা নিয়ে কথা হয় উ চি প্রু নামে কলেজ পড়ুয়া এক যুবকের সঙ্গে। বাড়ি রেমাক্রি হলেও বড় হয়েছেন থানচিতে। লেখাপড়া সূত্রেই বান্দরবানে থাকা।
উ চিও প্রথমেই জানালেন, শুধু স্কুল করলেই শিক্ষার হার বাড়ানো যাবে না। সবার আগে দরকার কয়েকটি পাড়া মিলে একটি ভালো স্কুল ও হোস্টেল। হোস্টেল অপরিহার্য। কারণ এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে গিয়ে পড়াশুনা করা সম্ভব হয় না। আর থানচি এসে থাকা এবং পড়াশুনার খরচ চালানো পাহাড়ের এই দরিদ্র মানুষগুলোর পক্ষে সম্ভব হয় না।
রেমাক্রি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মালিরাম ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, “পাহাড়ের মানুষ শিক্ষিত হোক সেটা আমরা মনেপ্রাণে চাই। তবে এটা বুঝি, প্রতি পাড়ায় পাড়ায় স্কুল দেওয়া কঠিন। সেক্ষেত্রে যদি কয়েকটি পাড়া মিলে একটি ভালো স্কুল ও হোস্টেল করে দেওয়া হয় তবে ছেলেমেয়েরা অনেক উপকৃত হবে। ”
তিনি আরও বলেন, “কয়েকবার এখানে অন্তত পাঁচটি স্কুলের টেন্ডার দিলেও কোনো লোক এখানে এসে কাজ করতে চায় না। ফলে স্কুল ভবনগুলোও শেষ পর্যন্ত হয় না। কারণ বিভিন্ন জিনিসপত্রের বহন খরচ অনেক বেশি পড়ে। আমরা অনেক চেষ্টা করেও এ বিষয়ে কিছু করতে পারিনি। ”
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসরিন সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, “ওসব এলাকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা অবগত। আমি এটুকু বলতে পারি- সরকার আন্তরিক। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি শিক্ষাসচিব বরাবর স্কুলের জন্য আবেদন করে, স্কুল পাবে। এ মুহূর্তে একটি প্রকল্পও চলছে। তারা ইচ্ছে করলে আগে আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারে। ”
এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে স্কুল শিক্ষক অমাচিং মারমা বাংলানিউজকে বলেন, “ওদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রথম প্রথম কষ্ট হয়। যা বোঝে না তা আমরা মারমা কিংবা ত্রিপুরা ভাষায় বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করি। বিশেষ করে মারমা ভাষায়। কারণ এ ভাষাটাই এখানে মোটামুটি সবাই বোঝে। তাছাড়া এখনও সব ভাষার বর্ণমালাও তো নেই। ”
হিউমেনেটেরিয়ানের পরিচালক মং মং সিং-এর কাছে প্রি-স্কুলিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ আমরা যদিও একটি বেসরকারি সংস্থা, তবু আমরা সরকারি কারিকুলামই ফলো করি। সে হিসেবে শিশু শ্রেণিতে যারা পড়ে তাদের শতভাগ মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। এভাবে পর্যাক্রমে প্রথম শ্রেণিতে ৮০ ভাগ, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৬০- এভাবে পঞ্চম শ্রেণিতে এসে তাদের আবার শতভাগ বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়। ”
বান্দরবান শিক্ষা অফিসের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা সাহিদা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, “আমি মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু দেখা যায়, জেলা সদরগুলোতে যে হোস্টেলগুলো রয়েছে, সেগুলো অধিকাংশই খালি। ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া যায় না। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন না হওয়ায় এটা হতে পারে। ”
যদি যেতে চান বান্দরবান: ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে শ্যামলী, হানিফ, ঈগল, সৌদিয়াসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি সকাল ৭টা- ৯টা এবং রাত ১০টা-১২টার মধ্যে কলাবাগান, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৬২০ টাকা। সময় লাগবে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। সময় লাগবে সাড়ে চার ঘণ্টা।
থানচি থেকে তিন্দু, রেমাক্রি, নাফাকূম, ছোটমোদক, বড় মোদক পর্যন্ত টানা নৌকা ভাড়া পড়বে দুই থেকে নয় হাজার টাকা। সময় লাগবে ৪ থেকে ১০ ঘণ্টা। আর ইঞ্জিন নৌকায় ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ১২ হাজার টাকা। সময় লাগবে ২ থেকে ৭ ঘণ্টা। তবে মৌসুম ভেদে নৌকা ভাড়া বাড়ে ও কমে। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচশ’ টাকা চুক্তিতে অবশ্যই নিতে হবে একজন গাইড।
বান্দরবানে থাকার পর্যাপ্ত হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ২০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত রুম ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া কটেজ ভাড়া নিয়েও থাকতে পারেন। খাবারেরও সমস্যা নেই। থানচি বাজারের পর যেখানেই যাবেন আপনাকে কারবারি বা কারও বাড়িতে থাকতে ও খেতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনাকে সব সহযোগিতা করবে গাইড। এমন একজন গাইড হলেন- মং মারমা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৭-৪১১০১৩ নম্বরে। ফোন করে যদি বন্ধ পান তাহলে বুঝবেন থানচিতে নেই তিনি। হয়তো কারো গাইড হয়ে গেছেন তিন্দু, রেমাক্রি বা বিজয় কেওক্রাডংয়ে। এক্ষেত্রে মোবাইলে মেসেজ দিয়ে তাকে বুক করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৩
জেডএম/